যত বই তত প্রাণ। বই না পড়ে অর্থোদ্ধার, আলো নয় তা অন্ধকার। বই পাঠককে আলোকিত করে, পথ দেখায়, যুক্তিবুদ্ধি জোগায়, চিন্তাশীল করে, ভেতরের সম্ভাবনাগুলো জাগিয়ে তোলে। পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অবাধ ও উন্মুক্ত চর্চার শক্তি যোগায়। সভ্যতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। বই সৃজনশীল মননশীলতা তৈরি করে; নতুন ভুবনে প্রবেশ করায়। স্বপ্নময় স্বাধীন চেতনা সৌধ নির্মাণে সহায়তা করে।
তাই নিজে বই কিনুন অপরকে কিনতে উৎসাহিত করুন । নিজে বই পড়ে জীবনে আলো ছড়ান। প্রিয়জনকে বই উপহার দিন । আসুন বেশি বেশি বই পড়ি। লেখক পাঠক বই, একত্রিত হই। বইকে নিত্য সঙ্গী করি। আলোকিত মানুষ গড়ি। হেনরি ওয়ার্ড বিশার বলেছেন, ‘বইয়ের মতো ভালো সঙ্গী আর কিছু নেই। বইয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়, বই উপদেশ দেয়, কিন্তু কিছু করতে বাধ্য করে না।’
অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেও শিখতে আগ্রহীরা বই পড়ে অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেও শেখেন। অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোর চেষ্টাও করেন। কিছু মানুষ অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার কিছু আছে বলে মনে করেন না। নিজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজে নিজে শেখেন। বই না পড়ে সময় বাঁচান আর বই না কেনে টাকা বাঁচান। কেউ কেউ বই পড়েন আনন্দের জন্য, কেউ কেউ বই পড়েন জানার জন্য।
ই-বুক এর যুগ এসেও কাগজের বইয়ের গুরুত্ব কমেনি। নতুন বইয়ের মলাট খুললে বের হওয়া ঘ্রাণ চমৎকার। পাতা হাতের আঙ্গুল দিয়ে উল্টায়ে পড়ার আনন্দই অন্যরকম। বইটা অর্ধেক পড়ে বালিশের নিচে রেখে ঘুমানোর অনুভূতিও ভিন্নরকম। লাখো পিডিএফ বই মেমরী কার্ডে রেখে ঘুরলেও এসব দারুণ দারুণ অনুভূতি পাওয়া অসম্ভব! তাইতো ইরানের কিংবদন্তী কবি গিয়াসউদ্দিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি বলেন- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইকে ‘অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো’ বলে বর্ণনা করেছেন। তার উক্তিটি হচ্ছে- ‘মানুষ বই নিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না—বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।’ চার্লস ল্যাম্বের উক্তি হচ্ছে- ‘বই পড়তে যে ভালোবাসে, তার শত্রু কম।’
বইকে সুন্দরের প্রতীক রূপে উল্লেখ করে সিডনি স্মিথ বলেছেন- ‘গৃহের কোনো আবসাবপত্রই বইয়ের মতো সুন্দর নয়।’ লিও টলস্টয় বলেছেন- ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।’ প্রমথ চৌধুরী ‘বইপড়া’ প্রবন্ধে বই কেনার গুরুত্ব উল্লেখ করে লিখেছেন- ‘বই কিনে কেউ দেউলে হয় না। যে জাতির যত বেশি লোক যত বেশি বই পড়ে, সে জাতি তত সভ্য।’ সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’। ইবসেন যথার্থই বলেছেন- ‘যার বাড়িতে একটি লাইব্রেরি আছে, মানসিক ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে সে অনেক বড়।’ আর লাইব্রেরি থাকার অর্থই হচ্ছে, বই থাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ম্যাগনেট, আরেক সেরা ধনী ব্যক্তি ওয়ারেন বাফেট তার পেশা জীবনের শুরুতে প্রতিদিন ৬০০-১০০০ পৃষ্ঠা নিয়মিত পড়তেন। বিল গেটস প্রতিবছর ৫০টি বই শেষ করেন। প্রতি বছরই তিনি তার দৃষ্টিতে ‘সেরা ১০টি বই’ পড়তে সবাইকে উৎসাহিত করেন। ইলন মাস্ক রকেট সায়েন্স এর বিদ্যা বইপড়ার মাধ্যমেই অর্জন করেছেন। মার্ক কিউবান প্রতিদিন ৩ ঘণ্টার বেশি বই পড়েন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রচুর বই পড়েন। ওবামা বই লিখেনও। বিল ক্লিনটন এবং হিলারি ক্লিনটনও বই পড়েন এবং বই লেখেন। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের অন্যতম শখ বই পড়া। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ছেলেবেলা থেকেই বই পড়েন। ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী ও সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ প্রতি দু’সপ্তাহে একটি বই পড়ে শেষ করেন। পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনও প্রচুর বই পড়তেন। প্রায় ১০ হাজার ভালো বইয়ের একটি লাইব্রেরিও ছিল তার। চাইনিজ প্রবাদ আছে, একটি বই পড়া হলো একটি বাগান পকেটে নিয়ে ঘোরার মতো।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, ‘লাইব্রেরি হচ্ছে এক ধরনের মনের হাসপাতাল।’ এখনো অনেক বইপোকাদের ঘরে রয়েছে বইয়ের সম্রাজ্য! রয়েছে অনেকেরই পার্সোনাল লাইব্রেরী! অনেকের বাসায়ও রয়েছে পাঠাগারের জন্য আলাদা কক্ষ। শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ বসে পড়ার মজাই আলাদা! আসলে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা খুব জরুরি। বইয়ের ধরন বুঝে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বুক শেলফের ব্যবস্থা করাও দরকার। বই বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজানো যেতে পারে। পরিবারে নানা বয়সের মানুষ থাকে। তাই বইয়ের সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ হতে হবে এবং বইয়ের যত্ন নিতে পারতে হবে।
স্পিনোজা বলেছেন, ভালো খাদ্য বস্তু পেট ভরে কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। দেকার্তে বলেছেন, ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সাথে কথা বলা। নেপোলিয়ান বলেছেন, অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। জন মেকলে বলেছেন, প্রচুর বই নিয়ে গরীব হয়ে চিলোকোঠায় বসবাস করব তবু এমন রাজা হতে চাই না যে বই পড়তে ভালোবাসে না। নর্মান মেলর বলেছেন,আমি চাই যে বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।
আর ডি কামিং বলেছেন, একটি ভালো বইয়ের কখনোই শেষ বলতে কিছু থাকে না। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়। জেমস রাসেল বলেন, বই হলো এমন এক মৌমাছি যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে পাঠকের জন্য নিয়ে আসে। ফ্রাঞ্জ কাফকা বলেন, আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাধা সমুদ্র সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই। মাও সেতুং বলেন, পড়, পড় এবং পড়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।
ফ্রান্সিস বেকন Of Studies প্রবন্ধে লিখেছেন, পাঠাভ্যাস মানবপ্রকৃতিকে নিখুঁত করে এবং তা আবার অভিজ্ঞতার দ্বারা নিকষিত হয়। চালবাজ লোকেরা পাঠকে ঘৃণা করে, সাধারণ লোকেরা প্রশংসা করে এবং জ্ঞানী লোকেরা ব্যবহার করে। পাঠ হবে বিচার-বিবেচনার জন্য। কিছু বই পড়তে হয় স্বাদ নেওয়ার জন্য, কিছু বই গিলে ফেলার জন্য, কতিপয় বই চিবিয়ে খেয়ে হজম করে ফেলতে হয়। কিছু বই অন্যের সহায়তা নিয়ে পড়া যায়, অন্যরা বইয়ের সারসংক্ষেপ তৈরি করে দিতে পারেন। পাঠ একজন মানুষকে পরিপূর্ণ করে, বাগানুশীলন একজন মানুষকে চটপটে করে এবং লেখালেখি একজন মানুষকে যথাযথ করে। কাজেই যে ব্যক্তি লেখালেখি করে না তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। যে ব্যক্তি কথার চর্চা কম করে, তার প্রজ্ঞায় ভাটা পড়ে। আর যে ব্যক্তি বই কম পড়ে, জানার ভাব দেখানোর জন্য তার ধূর্ততার প্রয়োজন হয়। ইতিহাসের পঠন মানুষকে জ্ঞানী করে, কবিতাপাঠ বুদ্ধিদীপ্ত করে, গণিতচর্চা যুক্তিবোধকে শাণিত করে, প্রাকৃতিক দর্শন নৈতিকতার ভিত্তি সুদৃঢ় করে। জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দরকার উপযোগী বই পাঠ। যেমন শরীরের অবস্থা অনুযায়ী ব্যায়াম করতে হয়। শরীরে পাথর জমলে বোলিংয়ে উপকার পাওয়া যায়, শুটিং করলে ফুসফুসের উন্নতি হয়, হাঁটাহাঁটি পরিপাকে সহায়তা করে, অশ্বচালনায় মাথার উপকার হয় ইত্যাদি। অজ্ঞতার ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত হবে পাঠপথ্য।
গ্রিসের থিবসের লাইব্রেরির দরজায় বই নিয়ে যে কথাটি খোদাই করা আছে তা হচ্ছে ‘আত্মার ওষুধ’ অর্থাৎ বই হলো আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। ইরানের একটি আদালতে নাকি সর্বোচ্চ শাস্তি বই পড়া। সঠিকভাবে বই পড়া মানুষ সহজে মন্দ কাজ করতে পারেন না। লেখক গুস্তাভ ফ্লবার্ট বলেছিলেন, ‘শিশুদের মতো শুধু আনন্দের জন্য বই পড়বেন না অথবা উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের মতো নির্দেশ পাবার জন্য পড়বেন না, পড়ুন জীবনকে জানার জন্য।’
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘শরীর সুস্থ রাখতেও বই পড়ার অভ্যাস দারুণভাবে মানুষকে সাহায্য করে। বই পড়ার সাথে শরীর এবং মনোজগতের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বই পড়লে অবশ্যই শারীরিক ও মানসিক সুফল পাওয়া যায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে বই সাহায্য করে। বইপড়া মানসিক চাপ কমিয়ে মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনে। আধ্যাত্মিক বই পড়লে রক্তচাপ কমে যায় অনেকটাই। বই পড়ার মধ্য দিয়ে মনকে সুস্থ ও আনন্দিত রাখা যায়।
২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাসেক্সের বৈজ্ঞানিকরা হার্ট রেট ও মাসেল টেনশন মনিটরিংয়ের মাধ্যমে লক্ষ্য করেন যে মাত্র ছয় মিনিটের জন্য বই পড়লে স্ট্রেস লেভেল ৬৮% পর্যন্ত কমে যায়, যা হাঁটা (৪২%), কফি পান (৫৪%) বা গান শোনার (৬১%) থেকে অনেকটা বেশি কার্যকর। ভালো বই মনশ্চক্ষু খুলে দেয়, জ্ঞান -বুদ্ধিকে প্রসারিত-বিকশিত করে, মনের ভিতরে আলো জ্বালাতে সাহায্য করে। Joseph Addison বলেছেন, Reading is to the mind what exercise is to the body.
ভালো বই অতুলনীয় সম্পদ। একটি ভালো বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনও নিঃশেষ হবে না, তা চিরকাল হৃদয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। একটা বই শুধু তথ্য দেয় না, প্রশ্ন দেয় এবং নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। ২৩৮ পৃষ্ঠার থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ বইটি লিখতে নেপোলিয়ন হিলের ২০ বছর সময় লেগেছে । স্বাভাবিক বইপড়ার গতিতে বইটি পড়ে শেষ করতে ৬ ঘন্টা লাগবে। তাহলে কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা ৬ ঘন্টায় জানা সম্ভব হচ্ছে। বই নতুনভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ও মস্তিষ্ককে চিন্তা করতে উপযোগী করে গড়ে তোলে। Andre Maurois বলেন, The art of reading is in great part that of acquiring a better understanding of life from ones encounter with it in a book .
বই পড়লে মানুষের জ্ঞানের দ্যুতি বাড়ে। আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি হচ্ছে বই। মানুষ বই পড়ে মনের খোরাকের জন্য, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার জন্য। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তা ও জ্ঞানের সূচনা বই থেকেই এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়ে পেয়ে থাকে।
অথচ বর্তমানে বইয়ের সাথে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে। অলস দুপুরে বালিশে হেলান দিয়ে কিংবা ভ্রমণে বাসে-ট্রেনে বসে বই বই পড়ে সময় কাটানো কিংবা এক টানে একটি বই পড়ে শেষ করার প্রবণতা এখন কমই দেখা যায়! বইপত্র বা খবরের কাগজের প্রবন্ধ ইত্যাদি পড়ার অভ্যাস দিন দিন কমছে! তাই পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির জন্য সচেতনতা তৈরি, ব্যক্তিগত-পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তোলা, পাঠাগারগুলোকে পাঠকের মিলনমেলা-প্রাণের মেলায় পরিণত করা এবং বইপড়ার সামাজিক আন্দোলনকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া সময়ের অপরিহার্য দাবি।