পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা কী, কেন ও কিভাবে

ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে প্রকাশনা শিল্প। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পা রাখছে বিদেশের মাটিতে। এ শিল্পে কাঠামোগত সমৃদ্ধি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়া।

পাণ্ডুলিপি কী

পাণ্ডুলিপি বলতে সেই কাজকে বুঝায়, যা কোনও লেখক প্রকাশক, সম্পাদক বা প্রযোজকের কাছে প্রকাশের জন্য জমা দেন।

copy: খণ্ড, আদর্শ, নকল করা, অনুকরণ করা, কপি, অনুলিপি, প্রতিলিপি, নকল, একখানা পুস্তক, অনুকরণ, পাণ্ডুলিপি, অবিকল প্রতিরুপ, কপি করা, প্রতিলিপি করা, টুকা, পরীক্ষায় টোকা

manuscript: পুঁথি, লেখ্য, পাণ্ডুলিপি, খসড়া, হস্তলিখিত, হস্তলিখিত পুস্তক, হস্তলিখিত কাগজ, এখনও ছাপা হয় নাই এমন, হস্তলিখিত পুস্তক বা কাগজ

scrivener: পাণ্ডুলিপি, মুনশি, প্রাচীন দলিলপত্রের মুসাবিদাকারী, দলিলের মুসাবিদাকারী

copybook: পাণ্ডুলিপি, পাঠ্যপুস্তক, আদর্শলিপি

পাণ্ডুলিপির বিন্যাস

পাণ্ডুলিপি বিন্যাস লেখকদের কাজের ধরনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট প্রকাশক, সম্পাদক বা প্রযোজকের উপর নির্ভর করে। যে লেখক একটি পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার ইচ্ছা রাখে তাদের প্রাসঙ্গিক লেখার মান নির্ধারণ করা উচিত এবং সেগুলি অনুসরণ করা উচিত।

প্রাকমুদ্রণ

কোনো সাধারণ পাণ্ডুলিপি কেবল তখনই ‘প্রকাশকের প্রাকমুদ্রণ’ হিসাবে বিবেচিত হয়, যদি এটি কোনোভাবে লেখকদের (বা প্রায়শই সহকর্মী যাদের কাছে তারা পরামর্শ চান) এর বাইরে বিতরণ করে। যদি কোনো লেখক তাদের কম্পিউটারে একটি পান্ডুলিপি প্রস্তুত করে পর্যালোচনার জন্য প্রকাশকের কাছে জমা দেন কিন্তু যদি এটি গৃহীত না হয়ে থাকে, সেখানে “প্রকাশকের প্রাকমুদ্রণ” থাকতে পারে না। লেখকত্ব প্রদর্শনের জন্য, কোনো লেখক সম্পূর্ণ প্রকাশের পূর্বে তাদের কাজের একটি সংস্করণ অনলাইনে আপলোড করতে পারেন। ‘প্রাকমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি’  অন্যকে দেোতে বা পরামর্শ নিতে ব্যবহার করা হয়।

নাটক পাণ্ডুলিপি

নাটকের লিখিত রূপকে পাণ্ডুলিপি বলে । একটি নাটকের পাণ্ডুলিপিতে সাধারণত অঙ্ক ও দৃশ্য বিভাজন থাকে। কাহিনীকে ভিত্তি ধরে বিভাজনকে বলা হয় অঙ্ক। আর নাটকীয় ঘটনা ঘটার স্থানকে ধরে যে বিভাজন করা হয় তাকে বলা হয় দৃশ্য। অধুনা নাটকের পাণ্ডুলিপিতে অনেক নাট্যকার অঙ্ক বিভাজন করেন না, কেবল দৃশ্য বিভাজন করেন।

একটি নাটকের পাণ্ডুলিপিতে প্রধানত যা যা থাকে: নাটকীয় ঘটনা ঘটার স্থান, নাটকীয় ঘটনা ঘটার সময়, নাটকীয় ঘটনা ঘটানোর পাত্র পাত্রী, নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা ও পাত্র পাত্রীর বলা মুখের কথা বা সংলাপ ইত্যাদি। এছাড়াও নাটকের কিছু টেকনিক্যাল দিক যেমন আলো, সেট, মিউজিক, কস্টিউম ও মেক আপ সম্পর্কে নির্দেশনা থাকতে পারে পাণ্ডুলিপিতে।

পাণ্ডুলিপিটি নিবন্ধন

বই নকল বন্ধে প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি বিক্রির আগে লেখকদের পাণ্ডুলিপি বা বইয়ের স্বত্ব নিবন্ধন (কপিরাইট) করে নিতে হবে।  লেখকদের পাণ্ডুলিপির নিবন্ধন না থাকায় বই নকলের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না প্রকাশক। তাই নকল রোধে লেখকদের বইটিকে স্বত্ব নিবন্ধন করে নেওয়া উচিত আগেভাগেই।

কপিরাইট শুধু প্রকাশ হওয়া বইয়ের ক্ষেত্রেই নয়, পাণ্ডুলিপিরও কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। কেননা কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে নকল করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। কপিরাইট আইন অনুযায়ী সাধারণত লেখক যে কয় বছর বেঁচে থাকবেন,  শুধু তিনিই ততদিন কপিরাইটের অধিকারী হবেন। লেখকের মৃত্যুর পর ষাট বছর পর্যন্ত তার উত্তরাধিকারীরা কপিরাইট ভোগ করতে পারবেন। এর পর সাধারণ জনগণ কপিরাইটের অধিকার ভোগ করতে পারবে।

বইয়ের স্বত্ব নিবন্ধন করতে লেখককে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত কপিরাইট কার্যালয়ে যেতে হবে। প্রথমে সেখানে উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। যে জিনিসটির ওপর আপনি স্বত্বাধিকারী চান, আবেদনপত্রে সেটির সকল বিবরণ, কার নামে স্বত্ব হবে, কী শর্ত হবে সবকিছু পূরণ করতে হবে। একই সঙ্গে পাণ্ডুলিপি বা বই দুই কপি করে জমা দিতে হবে।

স্বত্ব নিবন্ধনের ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত ফি প্রদান করতে হবে। এ ছাড়া হস্তান্তর সূত্রে, মালিকানার ক্ষেত্রে ৩০০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে হস্তান্তর দলিল দাখিল করতে হবে। যেকোনো বিষয়ের ওপর মৌলিক বই হলে পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে কপিরাইট আইন. ২০০০-এর বিধি বিধান মেনে লিখিত চুক্তি করতে হবে। চুক্তিতে অবশ্যই স্বত্বের অধিকার, স্বত্বের মেয়াদ, স্বত্ব নিয়োগের ভৌগোলিক পরিধি উল্লেখ থাকতে হবে।

চূড়ান্ত মুদ্রণ

ছাপাখানায় চূড়ান্ত মুদ্রণ হয়। চূড়ান্ত মুদ্রণের আগেই মুদ্রণসহ মুদ্রণ পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে নানাবিধ পরিকল্পনা করা হয়।

প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠাসজ্জা

পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ভালো মানের পৃষ্ঠাসজ্জার প্রয়োজন হয়। প্রচ্ছদ, লিপিবিন্যাস, নামপত্র, পৃষ্ঠাসজ্জা ও বাঁধাই যাতে আকৃষ্ট করে

লেখকের স্বঅর্থায়ন

সারাবিশ্বেই ভালো বইয়ের একটা বড় অংশ প্রকাশিত হয় লেখকের স্বঅর্থায়নে। লেখক ভাবতেই পারেন তার বই সম্পাদনাযোগ্য নয়। প্রকাশকও ভাবতেই পারেন এই বই তিনি ছাপবেন না। তখন বইটি প্রকাশে লেখকের স্বঅর্থায়নের বিকল্প থাকে না।  নিজের টাকায় বই প্রকাশ করলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে আপনাকে।

বইটির যেন আইএসবিএন নাম্বার থাকে। ইন্টারন্যাশনাল বুক স্টান্ডার্ড নাম্বার (ISBN) জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে এই নাম্বারটি প্রকাশকরা টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করেন। আপনার বইতে এই নাম্বারটি না থাকলে কোনো মূল্য নেই বইটির। বাংলা একাডেমির বইমেলায় কেন কোথা্ও বিক্রি হবে না এই বইটি। সরকারি সংগ্রহশালায়ও বইটি জমা নেবে না।

প্রুফসংশোধন ও সম্পাদনা

বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত থেকেও সবক্ষেত্রেই বই সম্পাদনার গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ অধিকাংশক্ষেত্রেই লেখক যা জমা দেন, কেবল বানান ঠিক করে তা প্রকাশ করা হয়। বাড়তি টাকা খরচ করে সম্পাদনার কাজটি নিয়মিত না করানোর ফলে ছাপানোর পর অজস্র বানান ভুল ও বাক্য গঠনে ত্রুটি দেখা যায়। ঠিকমতো প্রুফ দেখানোর কাজটি না করেই পাণ্ডুলিপি সরাসরি প্রেসে চলে যায়। সম্পাদনা ও প্রুফের যথাযথ চর্চা না থাকার ফলেই নাজুক আর নিম্নমানের প্রকাশনা হচ্ছে।

নির্দিষ্ট ভাষা বা বানানরীতির আলোকে যথাযথ সম্পাদনার অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু সৃষ্টিশীল লেখা সম্পাদনার করার মতো পণ্ডিত লোকেরও অভাব আছে। সম্পাদনা একটি পেশাদারিত্বের বিষয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারিত্বের অভাব আছে। বইতে পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু পুঁজি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার গুণগত মানও রক্ষা করা দরকার। সার্বিকভাবে বইয়ের মান বিচার করে বই প্রকাশ করা, বইগুলো নিজ দায়িত্বে সম্পাদনা করার দায়িত্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। অনেকে সম্পাদনার বিষয়টি মাথাতেই আনে না, সর্বোচ্চ প্রুফ রিডিংয়ে সীমাবদ্ধ থাকে।

বাতিল পাণ্ডুলিপি

শিবরাম চক্রবর্তীর ছোটবেলায় একটি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলেন সেকালের এক নামকরা পত্রিকায়। এরপর দিন গুনতে লাগলেন, কবে সেটি ছাপা হয়, সেই অপেক্ষায়। কদিন পরেই একটা চিঠি পেলেন শিবরাম। পাঠিয়েছেন ওই পত্রিকার সম্পাদক। চিঠি খুলে পড়া শুরু করলেন লাগলেন শিবরাম। তবে সেটা পড়ে খুশি হওয়ার বদলে বেশ একটু মন খারাপই হলো তাঁর। চিঠিতে লেখা: সংগীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভেতরে থাকলে, তা আটকে রাখা যায় না। তোমার মধ্যে যদি সেটি থাকে, প্রকাশ পাবেই। যথাকালে তা দেখা দেবেই। অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বের করার দরকার নেই।

জে কে রাওলিংয়ের কথা। তাঁর হ্যারি পটার সিরিজ বিশ্বব্যাপী ৪৫ কোটি কপি বিক্রি হয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বইয়ের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। অথচ এই বই লেখার পর প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল রাওলিংকে। একে একে ১২ জন প্রকাশক হ্যারি পটার–এর পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শেষমেশ ব্লুমসবারি প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেন।

রহস্যের রানি নামে পরিচিত আগাথা ক্রিস্টি ১৯১৬ সালে বড় বোনের সঙ্গে বাজি ধরে লিখলেন জীবনের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস। দ্য মিস্টেরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইল নামের সেই উপন্যাসটিতে জন্ম নিল সর্বকালের অন্যতম দুঁদে গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো। কিন্তু বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে রীতিমতো হতাশ হতে হলো আগাথাকে। বিচিত্র সব কারণে বইটি প্রকাশ করতে রাজি হলো না কেউ। প্রায় চার বছর স্রেফ বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে রইল সেটি। ১৯২০ সালে বইটি প্রকাশ করেছিল ব্রিটেনের জন লেন প্রকাশনী। তবে সে জন্য মাশুল হিসেবে বইটির শেষ দিকে বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছিল তাঁকে।

করণীয়

প্রচ্ছদটা যেন ভালো হয়, বানান ভুল যেন না থাকে, প্রচারটা যেন লেখক ঠিকমতো করতে পারেন— এসব দিকেই মনোযোগ দিতে হবে। বইটি প্রকাশযোগ্য কিনা, কোন জায়গায় পরিবর্তন-পরিমার্জন দরকার সেগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

www.banglatribune.com

উইকিপিডিয়া

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *