আনিসুর রহমান এরশাদের জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর থানার হাতীবান্ধা গ্রামে। তিনি পড়াশুনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। পড়েছেন মিডিয়া ও জার্নালিজমেও। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা, লেখালেখি ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত। পরিবার বিষয়ে তার লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি একটি ইউটিউভ চ্যানেলে মোঃ বাকি বিল্লাহর সাথে আলাপন পরিবার ডটনেটের পাঠকদের জন্য কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো। অনুলিখন ও প্রস্তুতকরণে ইসরাত জাহান সুমি।
বইটিতে কী আছে?
পারিবারিক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির গাইডলাইন বলা যেতে পারে বইটিকে। বন্ধন, প্রশান্তি, প্রেরণা ও বিকাশকে ফোকাস করা হয়েছে। ১৭ ফর্মার বই। ২৭২ পৃষ্ঠা। দাম ৫০০ টাকা। অফসেটে ছাপা। হার্ড কভার। ৮টি অধ্যায় আছে।
পরিবার শীর্ষক প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে- পরিবার কী, পরিবারের প্রকারভেদ, পরিবারের গুরুত্ব, পরিবারের কার্যাবলি, পরিবারহীনতার পরিণতি ও পরিবারের ইতিহাস।
পারিবারিক বন্ধন শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে- বাবার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, মায়ের ভালোবাসা অকৃত্রিম, বোনের মনে প্রীতির শিহরণ, ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনে আনন্দ, দাদা-দাদী ও নানা-নানী, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষক।
সন্তান লালন-পালন শীর্ষক তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে- প্যারেন্টিং, সুশিক্ষা, মানবিক গুণাবলি, অপরাধপ্রবণতা, ভুল সংশোধন, সঠিক সামাজিকীকরণ, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, শিষ্টাচার, কমনসেন্স, নীতি-নৈতিকতা-চরিত্র ও আব্রাহাম লিংকনের চিঠি।
পারিবারিক ব্যবস্থাপনা শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে- পারিবারিক রুটিন, পারিবারিক বাজেট, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, নেতৃত্বের বিকাশ, বিপদ মোকাবেলা ও ঝুঁকি হ্রাস, সময় ব্যবস্থাপনা, জীবন-যাপন পদ্ধতি, পারিবারিক কাজ, হালাল জীবিকা, অধিকার প্রতিষ্ঠা, সম্পত্তির ওয়ারিশ ও গৃহকর্ম-গৃহিণী।
নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা শীর্ষক পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে- পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, অপসংস্কৃতি, অশ্লীলতার চর্চা, প্রযুক্তির অপব্যবহার, যৌতুক, ধর্ষণ, ইভটিজিং, আত্মহত্যা, সামাজিক সমস্যা, মাদকাসক্তি ও গ্যাং কালচার।
করণীয় শীর্ষক ষষ্ঠ অধ্যায়ে রয়েছে- কোয়ালিটি টাইম, টেকসই উন্নয়ন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতা, প্রবীণবান্ধব হওয়া, পরিবারবান্ধব হওয়া, পরিবেশবান্ধব হওয়া, শিশুবান্ধব হওয়া, স্বাস্থ্যবান্ধব হওয়া, ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, অপরাধকে না বলা, মূল্যবোধের চর্চা, সমতার চর্চা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সচেতনতা এবং পারিবারিক সমস্যার সমাধান।
আদর্শ পরিবার শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে রয়েছে- আদর্শ পরিবারের বৈশিষ্ট, বিপদগ্রস্তকে সহযোগিতা, পরিবার থেকে বৃহত্তর জীবনে এবং ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে জগৎ পরিবর্তনে।
বিবিধ শীর্ষক অষ্টম অধ্যায়ে রয়েছে- দুটি চিঠি, এক সিঙ্গেল মাদারের উপলব্ধি, পরিবার সম্পর্কে বারাক ওবামা, প্রাসঙ্গিক চিন্তাধারা ও তথ্যসূত্র।
বই প্রকাশ করলেন- অনুভূতি কী?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তবে এখনো পাঠক সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে এটি পৌঁছেনি। পাঠক যদি বইটি পড়ে উপকৃত হয়, পাঠক যদি ভালোভাবে বইয়ের বক্তব্যকে গ্রহণ করে- তাহলে নিঃসন্দেহে সেটি আনন্দের হবে। পাঠক ভালো বললে- ভালো, মূল্যায়ন করবে পাঠক। সেই সময়টা এখনো আসেনি।
আসলে বই প্রকাশটা সমন্বিত প্রয়াসের ফলাফল। অনেকের মেহনত পরিশ্রমের ফল একটি সুন্দর প্রকাশনা। আমি লিখেছি। কিন্তু বাকি বিল্লাহ ভাই কভার ডিজাইন করেছেন, ভেতরের ইলাস্ট্রেশন করেছেন, আলোকিত ক্যাম্পাসের গিয়াস ভাই ও সানজিদা প্রিন্টার্সের শাহ আলম ভাই মুদ্রণ ব্যবস্থাপনা করেছেন, আবুল কালাম ভাই ও শামীম আল মামুন ভাই ব্যস্ততার মাঝেও প্রুফ দেখেছেন। তাছাড়া এই বইটির কিছু লেখা ইতোপূর্বে পরিবার ডটনেট, বাংলাদেশ২৪অনলাইন ডটনেট ও মাসিক এডুকেয়ারে নিবন্ধ-প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বই আকারে প্রকাশের ব্যাপারে বাকি বিল্লাহ ভাই বারবার উৎসাহিত করেছেন।
আর করোনাকালে বাসা থেকে অফিস করার সুযোগ পাওয়ায় পান্ডুলিপিতে মনোসংযোগ করাও সম্ভব হয়েছে। সুমি চা-কফির কাপ টেবিলে বারবার না পৌঁছাতো তাহলে হয়তো প্রেস পর্যন্ত পৌঁছাতেই অনেক দেরী হতো। ফলে আমি মনে করি কৃতিত্ব অনেকের, আর যে ভুল-ত্রুটিগুলো রয়ে গেছে তার দায়ভার আমার।
বই লেখার পেছনের কারণ কী?
পরিবার বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা ও কাজের কারণেই পরিবার বিষয়ক লেখালেখিটা করা হয়েছে-হচ্ছে এবং হবে। এর পেছনের গল্পটা হচ্ছে- সেভ দ্য ফ্যামিলি বাংলাদেশ। এরশাদ আহমেদ নিশান, জাহাঙ্গীর আলম জিসান, শামীম আল মামুন, নোমান মোশাররফ, শরীফুল ইসলাম সুমন, ইসরাত জাহান সুমিসহ অনেকের শ্রম ও চিন্তা এখানে রয়েছে।
আমি মনে করি, পরিবার -জীবনে গতিপথ বদলে দিতে পারে। সার্থক জীবনের সন্ধান দিতে পারে। টেকসই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে পারে। ভালো মানের ও ভালো মনের সুনাগরিক উপহার দিতে পারে।
লেখালেখির জগতে কীভাবে আসলেন?
এখনতো লেখি ভেতরের তাগিদ থেকেই। আর শুরুটা যদি বলি- ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে টা্ঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত আজকের টেলিগ্রাম পত্রিকায় ‘নকল’ কবিতাটি ছাপা হয়। ১৯৯৯ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সোনালী বার্তা সোনালী সাহিত্য পাতায় হাসি মুখ গল্পটি ছাপা হয়। প্রথম গল্প ও কবিতা ছাপা হয়েছিল আসলে সাংবাদিক মোজাম্মেল হক কাকার কল্যাণে। তবে আমার শিক্ষক ও কাকা মোঃ শামছুজ্জামানের লেখা কবিতা পড়তাম, ছোটফুফুর সাথে আবৃত্তি করতাম, আর বড় ফুফা সাইফুল ইসলাম সাগরের সুন্দর হস্তলেখায় লেখাগুলো পড়তাম-এগুলো লিখতে আগ্রহ তৈরি করে থাকতে পারে। আমার বাবা আমার পুরো ছেলেবেলাটাই প্রবাসে কাটিয়েছেন; ফলে উনি খুব সুন্দর হস্তলেখায় আমাকে ‘বাবা এরশাদ’ বলে সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। আমি চিঠির জবাব দিতাম। চিঠি লেখাও পড়াশুনার বাইরে লেখার ঝোঁক তৈরি করে থাকতে পারে। বি.এ.এফ শাহীন কলেজ ঢাকায়ও কলেজ বার্ষিকীতেও একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। নিবন্ধ প্রতিযোগীতায় পুরস্কার প্রাপ্ত একটি লেখা আদিত্য শাহীন সম্পাদিক জনভাষ্য নামের একটি সংকলন গ্রন্থে ছাপা হয়েছিল।
এরপরে ত্রৈমাসিক নতুন কণ্ঠ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেছিলাম। নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। দুলাল ভাই, তুহিন ভাই ও মাহবুব ভাই ছিলেন। প্রয়াস নামক একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেছি। অণ্বেষণ নামক নিবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছি। এরপর কাদের ভাইয়ের সাথে মাসিক এডুকেয়ার নামে শিক্ষা ও ক্যারিয়ার বিষয়ক একটি ম্যাগাজিন বের করি। নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। এরপর হেলাল ভাইয়ের সাথে পাক্ষিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পত্রিকায় কনটেন্ট এডিটর হিসেবে কাজ করেছি। তাছাড়া বিভিন্ন রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়াটা লেখালেখিতে উৎসাহ জুগিয়েছে।
আর অনলাইনে কাজের হাতেখড়ি অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য এডিটরে। মাহমুদুর রহমান মনা ভা্ইয়ের সাথে কাজ করেছি। সাজ্জাদ বিপ্লব ভাই, বশির ভাই, রোহান ভাই, আদনান পূর্ণ ভাই, রাসেল ভাই ছিলেন। এরপর সামহোয়্যার ইন ব্লগে লেখালেখি করা, পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন পরিবার ডটনেট চালু করা, ক্যারিয়ার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ক্যারিয়ার ইন্টেলিজেন্সের সাথে যুক্ত হওয়া, বাংলাদেশ২৪অনলাইন ডটনেটে সাথে যুক্ত হওয়া। এসবের মধ্য দিয়ে অনলাইনে কাজের অভিজ্ঞতা হয়।
আর এখনতো কাজ করতে করতে অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি। আর লেখালেখির জগতেই যেহেতু আছি, লেখালেখি করতে ভালোলাগে, লেখালেখি করাটাইতো স্বাভাবিক।
সেভ দ্য ফ্যামিলি বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলুন।
সংগঠনটির উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান ও পরিবারের যত্ন নেয়ার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি, পারস্পরিক বন্ধনগুলোক আরো সুদৃঢ় করা এবং পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যার সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে আরো সুন্দর করা।
সংগঠনটির পরিকল্পনায় থাকা প্রজেক্টগুলো হচ্ছে- রত্নগর্ভা মা সম্মাননা, যত্নশীল বাবা সম্মাননা, নিবেদিত পরিবার সম্মাননা, আইনি পরামর্শ, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, পারিবারিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, পরিবার বিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনা নারীর ক্ষতায়ন কেন্দ্র, শিশুর বিকাশ কেন্দ্র ইত্যাদি।
সংগঠনটি চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, বন্ধন হবে সুদৃঢ় ও জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা।
পরিবার নিয়ে কিছু বলবেন কী?
আামি বলব- পারিবারিক বন্ধন ও পারিবারিক মূল্যবোধকে সবেচেয়ে গুরুত্ব দিন। সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের মানসিক দূরত্ব কমান। পরিবারকে সময় দিন, পরিবারের যত্ন নিন। পরিবারের সদস্যদের মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটান। দুঃসময়ে সাপোর্ট দিন, সান্ত্বনা দিন। মনে রাখবেন- পরিবার চিরকালের জন্য পরিবার। আপনি যেখানে কর্মরত, কর্মক্ষেত্র আপনার মৃত্যুর পর আরেকজনকে নিয়ে নেবে। কিন্তু সন্তান মাতা-পিতা পাবে না, স্ত্রী স্বামীকে পাবে না; অনুপস্থিতি অনুভব করবে, শূন্যতা অনুভব করবে।
FAMIILY শব্দে ৬টি বর্ণ আছে। Forgiveness , Acknowledegment, Motivation , Inspiration , Love , within Yourself. এই ৬টির চর্চা বাড়ান। পরিবার যদি ভালো হয়, ব্যক্তি ভালো হবে, ব্যক্তি ভালো হলে দেশ বা রাষ্ট্র ভালো চলবে। একটি অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ার আন্দোলন পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পরিবারকে সুস্থ ধারার বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চার উর্বর ক্ষেত্র বানাতে হবে। গৃহের প্রশস্ততা, বড়ত্ব-চাকচিক্যের চেয়ে গৃহে থাকা মানুষগুলোর মানবিক মান-মর্যাদা ও সুখকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।