চিন্তার দর্পণ থেকে : এক

কারো ওপর এমন দায়িত্ব চাপানো উচিত নয়, যে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা তার নেই। দয়াশীলরা জয়ী হবার কারণ- তারা ক্ষমা করতে পারে, অন্যের ভুল ত্রুটিকেও উপেক্ষা করতে পারে। মাদকাসক্তের কাছে মাদকে যেমন নেশা, সুদখোরের কাছে সুদই নেশা, ঘুষখোরের কাছে ঘুষই নেশা, যৌন উন্মাদের কাছে বিকৃত-অবৈধ যৌনতাই নেশা, মিথ্যাবাদীর কাছে মিথ্যা বলাটাই নেশা। যারা এসবে অভ্যস্ত হয় সহজে তাদের হুশ ফিরে আসে না। কখনো স্রষ্টার ভয় বা ধর্মীয় অনুশাসন মানার সুযোগ হলে তাদের ঘোর কেটে যায়।

যারা খারাপ কাজ করে না, তাদের ভয় থাকে না। তারা থাকে আত্মবিশ্বাসী।দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না থাকায় তারা যে কোনো পরিস্থিতি মেনে নেয়ার মতো দুঃসাহস দেখাতে হয়। পাপীরা সাধারণত অহঙ্কারী হয়, তাদের মধ্যে ঔদ্ধত্য দেখা যায়; তবে তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ভীতুও হয়ে থাকে। সীমাবদ্ধতার কারণেই মানুষ অনেক কিছুকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে পারে না। একই সাথে বহু বিষয়ে সমান মনোযোগ দেয়াও সম্ভব হয় না। এজন্যই কাজের গুরুত্বানুযায়ী অগ্রাধিকার নির্ধারণের প্রয়োজন হয়।

যে অতীত ভুলে সে বর্তমানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না।যে বর্তমানকে বুঝতে পারে না সে ভবিষ্যতকেও অনুমান করতে পারে না।যে একসময় মায়ের পেটে ছিল, সেই একসময় মাটির পেটে যায়।মাঝে পৃথিবীতে কাটানো কিছু সময়ও স্রষ্টার কাছে গোপন থাকে না।তাহলে একান্ত বলে কিইবা থাকে! যারা দেখে তারা দৃষ্টিমান, আর যারা দেখে শিক্ষা নেয় তারা প্রকৃত দৃষ্টিমান। কাছে যতকিছুই থাকুক না কেন, যদি প্রয়োজনের সময় কাজে না লাগে তবে তা অর্থহীন।শাস্তিদানে কঠোর হওয়ার আগে ক্ষমা করার মতো দয়ালু হতে হবে।

যারা নিৎকৃষ্ট মানুষকে উৎকৃষ্ট মনে করে আর যারা উৎকৃষ্টকে নিৎকৃষ্ট মনে করে উভয়েই বিপথগামী। অন্তরে বক্রতা থাকলে অর্থপূর্ণ কিছুও অর্থহীন মনে হয়, স্পষ্ট কিছুও অস্পষ্ট লাগে। জ্ঞানীরাও সুযোগ-সুবিধার জন্য ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে; তবে প্রকৃত জ্ঞানীরাই অঙ্গীকারের পরিবর্তন করে না, সৎপথ থেকে বিচ্যুত হয় না। মানুষ হাসতে হাসতে অন্যায় করে, আশায় আশায় লোভে লোভে অপরাধ করে; অথচ এই ক্ষণস্থায়ী হাসি-আনন্দের পরিণতি যে কান্না ও চিরস্থায়ী দুঃখ তা বেমালুম ভুলে যায়।

স্রষ্টার সাহায্য যাকে শক্তিশালী করে। প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রুর বিরোধীতা তাকে দুর্বল করতে পারে না। উত্তমকে পুঁজি করে অধমও উত্তম হয়ে যায়। একে অন্যের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে গিয়ে মতভেদ বাড়ে, আর একে অন্যকে সহযোগী বানাতে চাইলে মতভেদ কমে।উত্তম আশ্রয়স্থল কেবল উত্তমরাই বেছে নেয়, অধমরা নেয় না।যারা পথ খুঁজে তারা পথ পায় পায়, যারা পথে থেকেও পথের মূল্য বুঝে না তারা পথ হারায়।

শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করা যেমন বোকামি, বন্ধুর সাথে শত্রুতা করাও তেমনি বোকামি। প্রকৃত বন্ধু ও প্রকৃত শত্রু চিনতে পারাটা তাই খুব জরুরি। সুসম্পর্কই সব সময় ভালো নয়, কার সাথে সম্পর্ক সেটিও বিবেচনার ব্যাপার।যিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন- তিনিও ক্ষমা করেন। অথচ তার ইচ্ছার বাইরে যিনি কিছুই করতে পারেন না- তিনিই ক্ষমা করতে চান না। যে যত বড় সে তত উদার, যে যত ছোট সে তত সংকীর্ণ, যে যত সংকীর্ণ সে তত অহংকারী। ভাবটা এমন যেন- সূর্যের চেয়ে বালি গরম! নদীর চেয়ে প্যাক ঠান্ডা! ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম!

সবাই সব আহ্বানে সাড়া দেয় না। ভালোর দিকে ডাকলেও যেমন কিছু মানুষ সাড়া দেয়, খারাপের দিকে ডাকলেও কিছু মানুষ সাড়া দেয়। জান্নাত আছে, জাহান্নামও আছে। শয়তান আছে, ফেরেশেতাও আছে। ফলে ন্যায়ের পক্ষে মানুষ আছে, ন্যায়ের বিপক্ষেও মানুষ আছে।পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, শত্রু-মিত্র থাকবে, ইতিবাচকতা-নেতিবাচকতা থাকবে। এসব বাস্তবতার মধ্যেই যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর তার পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

কেউ ধোঁকা দেয়, কেউ ধোঁকা খায়, তবে ধোঁকাবাজ কখনো জিতে না।মিথ্যা-প্রতারণার পথ, চূড়ান্ত ব্যর্থতার পথ। চালাকি-বজ্জাতির পথে প্রকৃত সাফল্য কখনো আসে না, কেউ কামিয়াবীও হয় না। যে ধোঁকা খায়, সে নিজে ঠকে; অন্যকে ঠকানোর চেয়ে নিজে ঠকা ভালো। সবচেয়ে বেশি ভালো ধোঁকাবাজ-ঠকবাজ-প্রতারকদের চিনতে পারা এবং তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পথে প্রকৃত বিজয় আসে না, বিজিত সেই যে সঠিক পথে সঠিক কাজ করে বিজয় লাভ করে; অবৈধ-অন্যায্য পথে বিজয় আসলেও তাতে সার্থকতা নেই।

গোপনেও এমন কাজ করা উচিত না, যা প্রকাশ পেলে মান-সম্মান-ইজ্জত ভূলণ্ঠিত হয়। আসলে মানুষেরতো গোপন বলতে কিছুই নেই, স্রষ্টা সব সময় সব দেখেন-শুনেন-জানেন।অন্তরে যা আছে, মনের যে ভাবনা আছে; সেসবও যিনি জানেন; লজ্জাতো তাকেই বেশি করার কথা! বদলোক বদ আমল করবে আর সৎ লোক উত্তম আমল করবে- এটাই স্বাভাবিক। ভালো কর্মফল আর মন্দ কর্মফল কখনো এক হয় না। তেল যেমন পানির সাথে মিশে না, আম গাছ থেকে যেমন কলা পাওয়া যায় না; তেমনি সৃষ্টিকর্তার প্রিয় বান্দাহর কাছ থেকে সৃষ্টিকর্তার অপ্রিয় বান্দাহর মতো আচরণ পাওয়া যায় না।

পাপকে ঘৃণা কর কিন্তু পাপীকে নয়। এর মানে এমন নয় যে- চোর, দুর্নীতিবাজ,সুদখোর, ঘুষখোরদেরকে ভালোবাসতে হবে। একজন মিথ্যাবাদী একারণেই আরেকজনকে অপছন্দ করতে পারেন যে সে সত্যবাদী। এজন্যই বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই! আসলে যে ধূমপানকেই পছন্দ করে না, আর যার মাদক ছাড়া চলেই না- দুজনের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হওয়া কঠিন ব্যাপার। মানুষ সাধারণ যে মানুষের সাথে নিজের তুলনামূলক বেশি মিল খুঁজে পায় তাকেই সহজে আপন ও কাছের ভাবতে পারে।

তবে সব সময় এমনও হয় না যে- নিজের জন্য যা পছন্দ করে তাই অন্যের জন্যও পছন্দ করে। যেমন নিজে পরকিয়া করলেও স্বামী/স্ত্রী পরকীয়া করুক কেউ পছন্দ করে না। নিজে ইয়াবা খেলেও সন্তান ইয়াবা খাবে এমনটা চায় না। নিজে নাইটক্লাবে গেলেও একই অভ্যাস আছে এমন ছেলের কাছে নিজের মেয়ে বিয়ে দিতে চাইবে না। অর্থাৎ একজন পাপী-অপরাধীও অনেক ক্ষেত্রে আরেকজন পাপী-অপরাধীকে বাছাই করতে চায় না। কিন্তু পূণ্যবানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। সে পূণ্যবান ও সৎ মানুষদেরকেই খুঁজে বেড়ায় এবং বেছে নেয়; এমনকি যে বর্তমানে খারাপ সেও যাতে ভবিষ্যতে ভালো হয় এমন আশা করে থাকে এবং সেই আশা পূরণে অনেকসময় চেষ্টাও করে থাকে।

বলা হয়ে যাকে ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম।অর্থাৎ নামে নয় কাজেই পরিচয়। সূর্যের চেয়ে বালি গরম। মানে যার যোগ্যতা যত কম তার আড়ম্বর তত বেশি।বলা হয়ে থাকে- খালি কলসি বাজে বেশি, ভরা কলসি বাজে না। যে নদী গভীর বেশি তার বয়ে চলার শব্দ কম। অর্থাৎ অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর। যে অল্প জানে সে নিজেকে পণ্ডিত মনে করে, অহংকারী হয়; আর যে যত বেশি জানে সে নিজের অজ্ঞতা তত বুঝতে পেরে আরো বিনয়ী হয়। যারা আত্মসমালোচনা করে আর যারা শুধু পরের সমালোচনা করে দুজন কখনোই সমান হয় না।

সমালোচকরা সহজেই পরনিন্দা, গীবত, পরচর্চায় লিপ্ত হয়; আর আত্মসমালোচনাকারী এসব এড়িয়ে চলে। কখনো কখনো সম্পর্কের শুরুটা ভালো না হলেও শেষটা মধুর হয়। আবার কখনো কখনো সম্পর্কের শুরুটা ভালো হলেও শেষটা তিক্ততায় ভরে যায়। ফলে সম্পর্ক অপরিবর্তনীয় কিছু নয়,সম্পর্কিত মানুষজনের আচরণ-ব্যবহারের ওপরই এর গতিধারা নির্ভর করে। সম্পর্ক চূড়ান্ত কিছু নয়, পরিচর্যার অভাবে সম্পর্ক ভাঙে আবার পরিচর্যা কারণে সম্পর্ক গড়েও।

About পরিবার.নেট

পরিবার বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘পরিবার ডটনেট’ এর যাত্রা শুরু ২০১৭ সালে। পরিবার ডটনেট এর উদ্দেশ্য পরিবারকে সময় দান, পরিবারের যত্ন নেয়া, পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা, পারিবারিক পর্যায়েই বহুবিধ সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরি করে সমাজকে সুন্দর করার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পরিবার ডটনেট চায়- পারিবারিক সম্পর্কগুলো হবে মজবুত, জীবনে বজায় থাকবে সুষ্ঠুতা, ঘরে ঘরে জ্বলবে আশার আলো, শান্তিময় হবে প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের মানবিক মান-মর্যাদা-সুখ নিশ্চিত হবে । আগ্রহী যে কেউ পরিবার ডটনেট এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিষয়ে লেখা ছাড়াও পাঠাতে পারেন ছবি, ভিডিও ও কার্টুন। নিজের শখ-স্বপ্ন-অনুভূতি-অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে পারেন সবার মাঝে। কনটেন্টের সাথে আপনার নাম-পরিচয়-ছবিও পাঠাবেন। ইমেইল: poribar.net@gmail.com

View all posts by পরিবার.নেট →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *