‘কোনো কাজের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে নেওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্য স্থির থাকলেই একজন কর্মী দক্ষ ও কর্মঠ হয়ে ওঠেন। ব্র্যাকের শুরু থেকেই এই নীতি আমরা মেনে চলেছি।
যে কাজ করতে পারব না, সে কাজে হাত দেব না। যে কাজ করব, সেটা ভালোমতো করব।
একটা উপলব্ধি হলো, পরিবার বা সমাজে আসলে দারিদ্র্য মোকাবিলা করেন প্রধানত নারীরা। যদি তারা দারিদ্র্যকেই ম্যানেজ করতে পারেন, তাহলে এদের দিয়েই আমরা উন্নয়নের কাজ আরম্ভ করি না কেন? আমি আগে যখন গ্রামেগঞ্জে বেশি যেতাম, দেখতাম পাঁচ বছরের মেয়েশিশু এক বছরের ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে দেখাশোনা করছে। আর তার বড় ভাইটা বাড়ির বাইরে গিয়ে খেলছে। এসব দেখে মনে হলো আমাদের মেয়েদেরই আগে তৈরি করতে হবে। আমরা মেয়েদের সংগঠিত করা শুরু করলাম। কারণ, মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ব্যবস্থাপনা শেখে।
বাংলাদেশের সহজাত সুবিধা হলো, মানুষগুলো বুদ্ধিমান। এদের যদি একটু ভালো শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যেসব দেশের মানুষ এতটা বুদ্ধিমান নয়। আমাদের লোকগুলো বেশি সুযোগ পায়নি কিন্তু তাদের মেধা আছে, বুদ্ধি আছে। এদের একটু সুযোগ দিলে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিচিতি পেত। আমাদের নায়ক আসলে দরিদ্র লোকেরাই, বিশেষত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সেই নারী, যারা জীবনের প্রতিটি পদে বাধার সম্মুখীন হন এবং তা কাটিয়ে ওঠেন।
যদি দুর্নীতি না থাকত, তাহলে আমরা আরও দ্রুত উন্নতি করতে পারতাম। দুর্নীতির কারণে দরিদ্র লোকেরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। ধনী লোকেরা পয়সা ঢেলে, ঘুষ দিয়ে আবার পয়সা বানিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু গরিব লোকেরা ঘুষও দিতে পারে না, পয়সাও বানাতে পারে না। তবে আমি আশাবাদী এই চক্র থেকে অন্যদের তুলনায় আমরা দ্রুতই বের হতে পারবে।
নতুন কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা দ্রুত টাকা বানাতে চান। আর আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ও হচ্ছে দিন দিন। ঘুষ ছাড়া নাকি দেশে এখন কোনো কাজই হয় না। এসব জিনিসের জন্য যারা খাদ্য ব্যবসায়ে আছে, তারা ভাবে আমি যদি আমার আয় ৩০ শতাংশ বাড়াতে পারি ভেজাল দিয়ে, তাহলে কেন নয়? এটা একটা চক্র। আর আমরা সবাই এই চক্রের ভেতর পড়ে গেছি।
আমরা খাবারে বেশি তেল ব্যবহার করি। আর আমাদের খাবার তালিকায় শর্করাও বেশি। বেশি বেশি তেল ও শর্করা ক্ষতিকর। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকের পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা নেই। আমরা মনে করি, পেটভরে খেলেই বুঝি ঠিকঠাকমতো খাওয়া হলো। প্রোটিন, ভিটামিন পরিমাণমতো খাচ্ছি কি না, একদমই ভাবি না।
আর আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা খাদ্যে ভেজাল। এর ফলে দেশে ক্যানসার বাড়ছে, ডায়াবেটিস বাড়ছে। খাদ্যে ভেজাল যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তবে সেটা আমাদের জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। এই যে ৩০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে, এগুলো তো আগে ছিল না। এগুলো হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের কারণে।
যেকোনো ব্যবসায় মুনাফা থাকবেই। মুনাফা ছাড়া ব্যবসা চলবে না। তবে আমরা তিনটি মন্ত্রে বিশ্বাস করি। তা হলো- মানুষ (পিপল), পৃথিবী ( প্লানেট) ও মুনাফা (প্রফিট)। আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে ভালোভাবে রক্ষা করতেই এ তিন মন্ত্র বা থ্রিপি। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে। গ্রিন এনার্জিতে বিনিয়োগ করছি। মানুষের যেখানে উন্নতি হবে, সেখানেই আমরা জোর দিতে চাই। এ কারণে আমরা ‘থ্রিপি’ অর্থাৎ পিপল, প্লানেট ও প্রফিটের ওপর জোর দিচ্ছি। এ তিনটি মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠান চলছে। এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন এক ধারণা।
ব্র্যাক সংগঠনটি অলাভজনক। কাজেই লাভজনক ব্যবসা শুরু করলেও এর মুনাফা যায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে অর্থাৎ ব্র্যাকে। কোনো একক ব্যক্তি এর সুফল ভোগ করে না। এটাকেই আমরা সামাজিক উদ্যোগ (সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ) বলি। বিষয়টিকে ওভাবেই বিবেচনা করতে হবে। এর দুটি দিক রয়েছে- প্রথমত. এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যক্তিশেয়ারহোল্ডার নেই। দ্বিতীয়ত. এগুলো হলো সামাজিক উদ্যোগ।
আমাদের রাজনীতি দেশের ওপর অনেকটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি দেশের ইতিবাচক অগ্রগতির পক্ষে নয়। বর্তমান রাজনীতি থেকে দেশ যত তাড়াতাড়ি ভারমুক্ত হবে, ততই মঙ্গল। নতুন প্রজন্ম যদি ইতিবাচক রাজনীতি করে, তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশের এমন চেহারা থাকবে না। আমাদের দেশের রাজনীতি জনগণের ওপর বিরাট বোঝা। আশা থাকবে, এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত, দারিদ্র্য বিমোচন, সম্পদের বণ্টনব্যবস্থা সুচারুভাবে সম্পন্ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।’
বাংলাদেশি সমাজকর্মী ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, কেসিএমজি এর বক্তব্য থেকে