আনিসুর রহমান এরশাদ
পারিবারিক বাজেট পরিবারের সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। কোনো পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট আয়, ব্যয় ও সঞ্চয় করার পূর্ব পরিকল্পনাকে পারিবারিক বাজেট বলে। এটি পরিবারের আয়ের উৎস ও চাহিদার ভিত্তিতে ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে পরিবারকেন্দ্রিক আয়-ব্যয়ের ভবিষ্যৎ পূর্বপরিকল্পনা। এটি পরিবারকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর ভিতর আনে যাতে করে আয়ের অতিরিক্ত ব্যয়ের কোনো সুযোগ না থাকে। বাজেটের মাধ্যমে পারিবারিক হিসাব নিকাশ পরিচালনা করতে পারলে নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যেই সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবন যাপন করা সম্ভব। পরিবারের নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আয় ও ব্যয়ের পূর্ব পরিকল্পনার সংখ্যাত্বক প্রকাশই হচ্ছে পারিবারিক বাজেট। নির্দিষ্ট সময় বলতে সাপ্তাহিক, মাসিক কিংবা বাৎসরিকও হতে পারে। আর বাজেট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রধান খাতগুলো হচ্ছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, সঞ্চয় ও চিত্তবিনোদন ইত্যাদি।
খরচের লাগাম টেনে ধরা
দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয়, মাস শেষে কিছু ঋণ যুক্ত হয়; যা রীতিমতো পীড়াদায়ক। অনেক সময় কোন খাতে কত খরচ করতে হবে তা না জানা থাকার কারণে বাড়তি খরচ হয়ে যায় যা মাস শেষে ঘাটতি হিসেবে দেখা যায়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হচ্ছে পারিবারিক বাজেট। এতে করে খরচের লাগামটা অন্তত টেনে ধরা যাবে। বর্তমান সময়ে খরচের খাতের এত বেশি শাখা-প্রশাখা যে হিসাব রাখাই কঠিন। পারিবারিক বাজেট এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে সহায়ক। খরচের লাগামহীনতার কারণে সঞ্চয়ের কথা মাথাতেই আনা যায় না বরং মাস শেষে হাত টানাটানি হয়। পারিবারিক বাজেটের অন্যতম সুবিধা হলো আয় অনুপাতে ব্যয়ের পথচলা সুগম করা, খরচের ক্ষেত্রে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা এবং ছোট ছোট সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা। আর এ সঞ্চয়ই আপনাকে বড় ধরনের সাপোর্ট দিতে সক্ষম। সাধারণ চাকরিজীবীদের অনেক সময়েই সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হয় না। তারপরও পথ চলতে হয়। পারিবারিক বাজেট সাধ-সাধ্যের মিলন না ঘটাতে পারলেও অন্তত পথ চলায় যেন কোনো বাধা না আসে সে লক্ষ্যেই প্রস্তুত করা হয়।
খরচের খাতগুলো চিহ্নিত করা
পারিবারিক বাজেটে আগে আয়-ব্যয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করুন। দিন দিন ব্যয়ের পরিধি যেভাবে বাড়ছে তাতে খরচের খাত মনে রাখাই মুশকিল। সে কারণে খরচের খাতগুলো লিখে নেয়া উচিত। কমন খাতের মধ্যে রয়েছে- খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসাভাড়া, বিল, যাতায়াত, ফ্যামিলি প্রোগ্রাম, ট্যুর, হাউস ওয়ার্কার ফি ইত্যাদি। গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো চিহ্নিত করতে বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করা উচিত। তা না হলে কার প্রয়োজন কতটুকু সেটা বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না। সে কারণেই প্রত্যেকের মতামত নেয়া উচিত। কখনই নিজের সিদ্ধান্ত কিংবা মতামত চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়।
চাহিদার গুরুত্বানুযায়ী অর্থ বণ্টন
গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো চিহ্নিত করার পর সেই খাত অনুযায়ী অর্থের বণ্টন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হতে পারে। যেমন পরিবারের সদস্যরা তাদের উপস্থাপিত খাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে চাইবে। বোঝানোর চেষ্টা করবে তার উপস্থাপিত অপশনগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী যদি বাস্তবের সমন্বয় না ঘটে তাহলে রি-অ্যাক্ট করতে পারে। এসব ব্যাপারকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে টেকওভার করতে হবে। তা না হলে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সবার উপস্থিতিতেই যে খাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে তার কারণ তুলে ধরা উচিত। পরিষ্কার ধারণার মাধ্যমে খাতের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। এতে করে কারো মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকবে না। বরং এ বাজেটকে গতিশীল করতে পরিবারের সদস্যরা এগিয়ে আসবে।
পরিকল্পিত পরিচালনায় অর্থ সাশ্রয়
একটি পারিবারিক বাজেট প্রস্তুত করা প্রথমে কঠিন মনে হলেও পরবর্তীতে তা সহজ হয়ে যায়। কৃপণতা না করেও পরিকল্পিত বাজেটানুযায়ী পরিবার পরিচালনা করলে অর্থ সাশ্রয় হয়। পরিবার যদি সুনির্ধারিত বাজেট মেনে চলে তবে বাড়াতে পারবে অর্থ সঞ্চয়, কমাতে পারবে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত খরচ। ঋণ না নিয়েই সামর্থ্যানুযায়ী পছন্দ-সাধ পূরণে সক্ষমতা বাড়াতে পারবে, আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করতে পারবে এবং চাহিদাগুলোর মধ্যে দ্রুত অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারবে।
পারিবারিক বাজেট তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে- পরিবারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যতার পথ বের করা। সমস্ত বিল, প্রদত্ত চেক, ব্যাংক স্টেটমেন্টগুলো সংগ্রহ করা। যা কত অর্থ আসছে বা বাইরে চলে যাচ্ছে সেই হিসাবে সহায়ক হবে। অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মিতব্যয়ী বাজেট করুন। বাজেট ছাড়া মাসের পর মাস চললে অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো কমাতে এবং অর্থ সঞ্চয় করতে ব্যর্থ হবেন। কয়েক মিনিট ব্যয়ে একটি বাজেট তৈরি করলে পরবর্তীতে অনেক টাকা সংরক্ষণ করতে পারবেন।
প্রয়োজন অনুসারে তালিকা প্রস্তুত করা
পারিবারিক বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে যদি নির্ধারিত নিয়মনীতি মেনে বাজেট প্রস্তুত করা হয়; তা বাস্তবধর্মী এবং যুক্তিসংগত হয়। যে সময়ের জন্য বাজেট প্রণয়ন করা হবে যে সময়ে পরিবারের সদস্যদের কাক্সিক্ষত দ্রব্যের তালিকা নিয়ে তার মধ্যে থেকে প্রয়োজন ও চাহিদার গুরুত্ব অনুসারে তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি দ্রব্য বা সেবাকার্যের মূল্য জেনে নিয়ে একত্রে মোট মূল্য বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পারিবারিক বাজেটে সাধারণত আয়ের উপর ভিত্তি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
সেই জন্য বাজেটকে কার্যকরী করতে হলে সম্ভাব্য আয়ের সকল উৎস সঠিকভাবে চিহ্নিত করে মোট আয় বাজেটে উপস্থাপন করতে হবে। সীমিত আয়ের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করার লক্ষ্যে বাজেট প্রণয়ন করার সময় খেয়াল রাখতে হবে আয়-ব্যয়ের মধ্য যেন ভারসাম্য বজায় থাকে অর্থাৎ ব্যয় যেন আয়ের চেয়ে বেশি না হয়। তাছাড়া বাজেটের ব্যাপারে নমনীয় হতে হবে যাতে বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি খরচ বেড়ে গেলে অন্য একটি খরচ কমানো যায়।
আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনা
একটি সার্থক বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ভর করে পরিবারের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর। পরিবারের গঠন, আকৃতি, পরিবারের আয়, সদস্যের রুচিবোধ সামাজিক পরিচিতি ইত্যাদি উপাদানগুলো সক্রিয়ভাবে বাজেট প্রণয়নের সময় বিবেচনায় রাখতে হয়। তাছাড়া প্রতিটি পরিবারের বাজেট একরকম ও একই মানে তৈরি করা সম্ভব হবে না। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য থেকেই একটি পারিবারিক বাজেট তৈরি হয়।
ব্যয়ের খাতওয়ারি বণ্টন নির্ভর করবে পারিবারিক কাঠামোর উপর। যেমন- খাদ্য খাতে শতকরা ২০%-২৫%, বস্ত্রখাতে ৫%-১০%, বাসস্থান খাতে ৩০%-৪০%, শিক্ষাখাতে ১০%-১৫%, যানবাহন খাতে ১৫%-২০% খরচ করা যেতে পারে। পারিবারিক লেনদেনগুলো বিভিন্ন হিসাব বহিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধকৃত লেনদেন থেকে পরিবারের আর্থিক বুনিয়াদ এবং আয়-ব্যয়ে কোনো চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ জন্য আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করা অপরিহার্য; যার ধাপসমূহ হলো- ১। প্রাপ্তি ও প্রদান হিসাব ২। আয় ব্যয় বিবরণী ৩। আর্থিক অবস্থার বিবরণী।
আর্থিক লক্ষ্য পূরণ
আর্থিক লক্ষ্য পূরণে বাজেট সহায়ক। মাসের পর মাস বিল পরিশোধ করার জন্য সংগ্রাম করছেন, সঞ্চয় করার মতো অর্থ সর্বদা নাগালের বাইরে থাকছে। সন্তানের পড়াশুনা কিংবা অবসর জীবনের জন্য অর্থ সঞ্চয় করে পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করতে পারছে না। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় ধরণের লক্ষ্যেই পারিবারিক বাজেট থাকতে পারে। আর্থিক লক্ষ্য পূরণে বিদ্যুৎ বিল কমানো, ডিস লাইন বন্ধ করা বা অন্যান্য খরচগুলে দ্রুত হ্রাস করতে হবে। দেনা থেকে মুক্ত না হয়ে প্রয়োজনীয় ও বাস্তবসম্মত লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা কঠিন হবে।
অবশ্য ঋণ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার মাধ্যমে ঋণ পরিচালনা করা সহজ। ফলে পারিবারিক বাজেটে ঋণ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা থাকতে পারে। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমিয়ে বন্ধকীসহ সার্বিক ঋণ কমাতে পারেন। আজকেই সমস্ত ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবেন না, তবে ঋণ পরিশোধে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন। বাজেট দেখাবে অপ্রয়োজনীয় খরচে ঋণের টাকার উচ্চ সুদ কতটা ক্ষতিকর। অর্থ কোথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যয় করতে হবে তা চিহ্নিত করাও সহজ হবে।
ব্যয়ের অগ্রাধিকার তালিকা করা
কর কমাতে সঠিক হিসাব নিশ্চিত করুন, করের নিয়মগুলো জানুন, ফাইল করার সময় সচেতন থাকুন, যেসব ব্যয় অবধারিত প্রয়োজনে সেগুলো আগে করে ফেলুন। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় জরুরি তহবিল প্রতিষ্ঠা কম প্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে সঞ্চয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। দুর্ঘটনায়ও যাতে আর্থিক কষ্ট থেকে পরিবার রক্ষা পেতে পারে। বিলাস দ্রব্য বা আনন্দ-সুখ-শান্তির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় অনেক সময় প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা কমায়। খাদ্যে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
একটি সুসংগঠিত খাদ্য বাজেট পরিবারের ভোজন খরচ কমায়। পরিবারের পছন্দের রেসিপিগুলোর আলোকে উপকরণগুলো মুদিদোকান থেকে কিনে বাসায় তৈরি হলে খরচ কমবে। খাবার হতে হবে পুষ্টিকর, শুধু মুখরোচক নয়। ফাস্টফুড আর রিচফুড শুধু নয়, পরিকল্পিত মেন্যুর আলোকে কম দামি খাবারও উপভোগ্য ও সুস্বাদু হতে পারে। খাবার মোটেই অপচয় করবেন না, নষ্ট করবেন না।
অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা
ছুটি কাটাতে বা ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাজেট নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সময় বিবেচনা করে এমন প্লেøস ঠিক করুন যে ভ্রমণে আনন্দলাভ হবে, শিক্ষণীয় হবে আবার খরচও কম হবে। পরিকল্পনায় এমন কৌশলী হতে হবে যাতে অতিরিক্ত কেনাকাটা বা ব্যয়ের সুযোগ তৈরি না হয়। খরচ করার আগেই খরচটি সম্পর্কে চিন্তা ও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বাচ্চাদের লালন পালন খুব ব্যয়বহুল। বাচ্চার জন্ম থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কত খরচ হয়? পরিবারে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য পারিবারিক বাজেটের বিকল্প নেই। এমন কিছু ব্যয় আছে যেগুলো অনর্থক অথচ কারো শখ পূরণ বা ঝগড়া-অভিমান-ক্ষোভের অশান্তি থেকে বাঁচতে করা হয়; যদিও ব্যয় পর্যন্তই শেষ, পরবর্তীতে তা কোনো কাজে লাগে না। আর এসব করতে গিয়ে খাদ্য, বাসস্থান, পরিবহন ও শিক্ষাখাতের অতীব প্রয়োজনীয় ব্যয়গুলোও সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ে। জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে বাসা পরিবর্তন হতে পারে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসতে পারে কিংবা শহর কিংবা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন হতে পারে। গৃহস্থালি বাজেট তাই মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
অর্থ ব্যবস্থাপনায় সহায়ক
পারিবারিক বাজেট চিন্তা করতে সহায়তা করে পরিবার সবচেয়ে বেশি টাকা কোথায় ব্যয় করছে এবং কোথায় সংরক্ষণ করার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি পরিবারের বাজেট তাদের নিজস্ব পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। প্রতিমাসে কিছু নিয়মিত ব্যয় থাকে আবার কিছু এককালীন ব্যয় থাকে। কয়েক মাসের খরচ পর্যালোচনা করলে সম্ভাব্য কত সঞ্চয় করতে পারবেন তা অনুমান করা সহজ হবে। সামর্থ্য নির্ধারণ পরিবারের অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য খুব দরকার। দেখা গেলো আসবাবপত্র ক্রয়ে এত বেশি ব্যয় করে ফেললেন যে বাচ্চার শিক্ষকের বেতন দিতে পারছেন না! এমনটি যাতে না হয় সেজন্য সতর্ক ও দায়িত্বশীল থাকতে হবে। অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলতা খুব বেশি প্রয়োজন। পরিবারের নিয়মিত প্রয়োজনীয় খরচ চালানো আগে, পরে অন্য কিছু।
চাপ কমিয়ে দেয়
যদি জানেন জানুয়ারি মাসে বাচ্চাদের জন্য নতুন জামাকাপড়, জুতা এবং স্কুলের উপকরণাদি কিনতে বিশেষ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে, তাহলে ছয় মাস আগে থেকেই অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে থাকুন এতে ঐ মাসে আলাদা চাপ অনুভব হবে না। প্রিয়জনদের উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিন সেটিকে যেটি তখন না দিলে পরে কিনে দিতেই হবে। অবকাশের জন্য বাজেট পরিকল্পনা করতে ভুলবেন না! ছুটিতে ইচ্ছেমত খরচ নয়। অর্থ আয়ই সব নয়, অর্থের উত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। অগ্রিম পরিকল্পনা ছাড়া সর্বোত্তম ব্যবহার হয় না। একসাথে ছুটি কাটানো পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার হাতিয়ার হতে পারে এবং এ জন্য একটি বাজেট বছরের শুরুতেই করতে হবে, পরে প্রয়োজনে সংশোধন হতে পারে।
ঋণ ব্যবস্থাপনায় সহায়ক
পরিবার যদি ঋণের সম্মুখীন হয় তবে পারিবারিক ঋণ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খরচ এবং ঋণ অগ্রাধিকারের জন্য বাজেট তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে আপনি ঋণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। ঋণ সুদমুক্ত হওয়া জরুরি। ঋণের ব্যাপারে পরিবারের সদস্যরা অবহিত হলে অনেক সময় ঋণ নেয়ার প্রয়োজনই মিটে যেতে পারে। ঋণ করে ফেললে ঋণ পরিশোধের অর্থ সংগ্রহে প্রয়োজনীয় খরচ হ্রাস করার উপায়ও খুঁজে পেতে পারেন। ঋণ যাতে কখনো বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। নগদ অর্থের জন্য বাড়ির অব্যবহৃত আইটেমগুলো বিক্রি করা যেতে পারে। মূল আয়ের উৎসের পাশাপাশি পার্শ্ব কিছু ব্যবসাও চালু করতে পারেন। যেমন সেলাই বা হাতের অনেক কাজ করা অনেকের শখ, যা অর্থও আনতে পারে। ছাত্ররা ঋণ না নিয়ে বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারে। সন্তান যদি সঠিকভাবে অর্থের সাথে যুক্ত বিষয়গুলোতে সচেতন হতে শিখে তবে সে আর্থিক বাধা দূরে রাখতে পারবে।
কেনাকাটাকে নিয়মের মধ্যে আনা
পারিবারিক বাজেট করার ক্ষেত্রে অনেকেই এখনো অনিচ্ছুক। অথচ খরচ ও কেনাকাটাগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার জন্য বাজেট সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে-প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় অর্থ ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। এছাড়াও লক্ষ্য হতে পারে- একটি বাড়ি ক্রয়, গাড়ি ক্রয় কিংবা বিদেশ ভ্রমণ বা হজ্ব পালন। বাজেট নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে লক্ষ্যানুযায়ী দরকারি অর্থ পেতে সহায়তা করতে পারে। কোন খাতে কত খরচ হবে তা জেনে বাস্তবসম্মত বরাদ্দও করা যায়। যেই খাতে পরে খরচ করলেও চলতো তাতে খরচের কারণে জরুরি খাতের ব্যয় নির্বাহে সমস্যা হলে তা বিড়ম্বনা তৈরি করে। স্বপ্ন পূরণে মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের জন্য রাখা উচিত। বিনিয়োগের বরাদ্দ ছোট হলেও তা সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খোলে দেয়। ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযমী আর আয়ের ক্ষেত্রে পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান হলে সম্ভাবনা বাড়ে। মাসের শুরুতেই পরবর্তী ৩০ দিনের সমস্ত খরচের ধারণা থাকলে সমন্বয়গুলো সঠিকভাবে করা সহজ।
ব্যয় সাশ্রয়ে কৌশলী হওয়া
পারিবারিক বাজেটে সম্ভাব্য ব্যয় হিসাব করা হয় আয় দৃষ্টে। অর্থসংস্থান অর্থ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যখাত, বস্ত্রখাত, বাসস্থানখাত, শিক্ষাখাত, চিকিৎসাখাত, বিনোদনখাত, পর্যটন খাত, ডিশ বিল, পত্রিকার বিল, ইন্টারনেটের বিল, বিয়ের দাওয়াতে অংশগ্রহণ, ঋণ পরিশোধ খাত ও ঘাটতি মোকাবিলা ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়। জাতীয় বাজেটের প্রত্যক্ষ প্রভাব পারিবারিক বাজেটেও পড়ে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। চিনির দাম বাড়লে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক চিনি এড়িয়ে চলুন। ব্র্যান্ডের পোশাকের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে ফেলুন। মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পনিগুলো কলরেট বাড়ালে পরিবারের সকলকেই মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপারে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করুন। কিছু শাকসবজি নিজের বাসার ছাদে চাষ করুন কিংবা মাশরুম চাষ করতে পারেন। পরিবেশ ভালো থাকবে, শরীর-মন ভালো থাকবে আবার অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ও হবে।
অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দেয়া
সংসারের বাজেট হতে হবে চাহিদার গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে। মাসের শুরুতে পুরো মাসের আয় ব্যয়ের হিসাব করুন এবং কোন জিনিসটির প্রয়োজন আর কোনটি না হলেও চলবে সেটা ঠিক করে নিন। বাজেট তৈরি করার পর অপ্রয়োজনীয় কোনো খরচ লক্ষ্য করলে বাদ দিন। মাসের বাজার শুরুতেই একসাথে করলে সাশ্রয় হবে খানিকটা। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে বেশি করে মাছ মাংস কিনে নিতে পারেন। চাল, ডাল, দুধ ও আটা পুরো মাসের জন্য কিনে ফেলুন। সাশ্রয় বা সঞ্চয়ের জন্য খরচের ব্যাপারে যথাসম্ভব কৌশলী ও মিতব্যয়ী হোন। কেনাকাটায় বেহিসাবি হবেন না কখনো। সবচেয়ে ভালো হয় বাজার করতে যাওয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা সাথে না নিলে। সুপার শপগুলোতে কিছু কেনার আগে দাম দেখে নিন। দৈনন্দিন খরচের লাগামটাও টেনে ধরুন যতোটা সম্ভব। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় যে মাছ মাংস থাকতে হবে এমন নয়। বরং মাছ অথবা মাংস যেকোনো একটির সঙ্গে শাক-সবজি ও ডাল রাখুন। এতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচের হাত থেকেও বাঁচা যাবে। বাইরে খাবারের অভ্যাস পরিবর্তন করুন। সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে হলে বাজেটের শুরুতেই উপহার খাতে বাড়তি খরচ যোগ করে বাকি খাতগুলোর সাথে সমন্বয় করে নিন। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান থাকলে সেটাও বাজেটে রাখুন। বাসায় অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা অতিথি থাকলে বাজেটে তারতম্য ঘটতে পারে। সম্ভব হলে তাদের জন্য আলাদা খাত করুন।
ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা
দৈনন্দিন বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হোন। অতিরিক্ত ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। খুব দূরের পথ না হলে হেঁটেই যাওয়া আসা করুন; এতে যাতায়াত খরচ বাঁচবেই, শরীরও ভালো থাকবে। বাসে বা রিকশায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য সবসময় খুচরা টাকা সঙ্গে রাখুন। সৃজনশীল কাজে পটু হলে বিভিন্ন উপলক্ষে আত্মীয় স্বজনকে দিতে পারেন হাতে তৈরি করা নান্দনিক উপহার; এতে খরচ কমবে। শিশুরা কিছু চাইলেই কিনে না দিয়ে ছোটবেলা থেকেই অতিরিক্ত খরচের কুফল সম্পর্কে শিখান। অর্থ সাশ্রয় করার পাশাপাশি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে তুলুন।
প্রয়োজনে দু একটি খরচ কমিয়েও ভবিষ্যতের জন্য বেতনের কিছু অংশ প্রতি মাসে ব্যাংকে রেখে সঞ্চয় করুন। ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয়ের জন্য নানা স্কিম রয়েছে। এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় প্রকল্পের আওতায় সেভিংস করা যেতে পারে। শিশুদের সঞ্চয়ে উৎসাহী করার জন্য বাহারি ডিজাইনের মাটির বা প্লাস্টিকের ব্যাংক কিনে দিতে পারেন। কাছে কোথাও যেতে হলে না হয় হেঁটেই গেলেন। তাতে খুচরা খরচটাও বাঁচানো গেল। প্রয়োজনীয় সকল খরচ করার পর শৌখিন দু একটি জিনিস কেনার জন্য কিছু খরচ রাখতে পারেন। তবে শৌখিন জিনিসগুলো একবারে না কিনে প্রতি মাসে অল্প অল্প করে কেনা উচিত।
বাজারে অর্থ সাশ্রয়
সুপারশপ বা অনলাইন থেকে বাজার করলেই যে খরচ বেশি হবে, তা নয়। কাঁচাবাজারেও ঠকার আশঙ্কা আছে। বাজার করুন ঠাণ্ডা মাথায়। বুদ্ধি করে বাজার করলে সব স্থান থেকেই অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। রোজকার বাজারে নিজের অজান্তেই অনেকে বেশি অর্থ খরচ করে ফেলে। চাল, ডাল, চিনি, গুঁড়ো দুধ, আটা-ময়দা, তেলসহ কিছু জিনিস মাসের শুরুতে বিভিন্ন কোম্পানির শো রুম বা পাইকারি দোকান হতে অল্প দামে একসঙ্গে কেনা যায়। ৫ লিটারের তেলে ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় করা যায়। পচনশীল জিনিস অল্প করে কেনাকাটা করলে অপচয় হবে কম আর অর্থ বাঁচবে। কিছু পণ্য সুপারশপে অল্প দামে পাবেন, কিছু পণ্য কমদামে পাবেন কাঁচাবাজারে; তাই বুঝে কেনাকাটা করুন।
বেশি মাছ বা মাংস কিনতে হলে কাঁচাবাজারেই গেলে মাপে ঠকার সম্ভাবনা কম, দরদামও করা যাবে। আধা কেজি মাছ বা মাংস তথা অল্প কিছু কিনতে সুপারশপেই যাওয়া ভালো, কাঁচাবাজারে ঠকবেন। সুপারশপে ২৫০ গ্রাম কেনার ব্যবস্থাও আছে। যেসব পণ্য ছোট প্যাকেট কিনলে দাম বেশি আর বড় প্যাকেটে কম, সেগুলো একটু বড় প্যাকেটই কিনুন। যত্ন করে রাখলে নষ্ট হবে না। মশলা কিনে ধুয়ে শুকিয়ে মেশিনে ভাঙিয়ে গুঁড়ো করে নিন, প্যাকেটজাত কিনবেন না।
সুপার শপ ও অনলাইন বাজারগুলোতে কফি, সাবান, শ্যাম্পু, হারপিক, ওয়াশিং পাউডার, বিস্কিট ইত্যাদিসহ সংসারের বিভিন্ন পণ্যে নানা রকম প্রমোশনাল অফার থাকে, যা সাধারণ কাঁচাবাজারে থাকে না। এই অফার থেকে নিজের প্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনলে অনেকটা অর্থ বাঁচবে। বেশি করে নুডুলস বা বিস্কিটের মতো প্যাকেটজাত শুকনো খাবার কিনে রাখবেন না; বেশিদিন সতেজ না থাকায় অল্প করে কেনবেন, নতুবা অর্থ নষ্ট হবে। বাজার করার অনলাইন সাইটগুলোর ডিস্কাউন্ট ও নানান রকমের অফারের সদ্ব্যবহার করুন। সুপারশপ থেকে বাজার করলে কার্ড করিয়ে নিন, কার্ডে পয়েন্ট জমা হলে তা খরচ করে আবার পণ্য কেনা যায়। বিভিন্ন ফোন অপারেটরে ডিস্কাউন্ট থাকে বিভিন্ন সুপারশপে বাজার করার। বিকাশসহ নানান অ্যাপ ব্যবহার করে বাজার করলেও ক্যাশ ব্যাক পাওয়া যায়। এসব অফারগুলো খুঁজে নিন। নিয়মিত শপিং করলে জিনিসের দাম সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা চলে আসায় ঠকার আশঙ্কা কমে।
কেনাকাটা করতে শপিং সেন্টার পরিহার করুন। দিনের শেষ ভাগে কেনাকাটা করবেন না, দিনের শুরুতে কেনাকাটা করুন। কেনাকাটাকে সহজ ও গোছানো করতে মার্কেটে গিয়ে কী কী পণ্য ক্রয় করবেন তার একটি নির্দিষ্ট তালিকা আগেই প্রস্তুত করে রাখুন, নিজের পণ্য তালিকা অনুসারে একটা বাজেট করুন। তালিকায় লিখে রাখুন কোন পণ্য কোথায় থেকে কিনলে ভালো জিনিস পাওয়া যাবে। দোকানের খ্যাতি ও পণ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন, অখ্যাত কোন দোকান বা প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। দোকানে ভিড় বেশি থাকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে অন্য দিনে কেনাকাটা করার চেষ্টা করুন।
জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকায় যে কোনো সামাজিক উৎসবের আগে কেনাকাটা করা থেকে বিরত থাকুন। কেনাকাটার জন্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কার্ড ব্যবহার করে সামান্য লাভ করতে গিয়ে অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কেনাকাটার সময় সম্পর্কে সচেতন থাকুন, কখনো দীর্ঘ সময় কেনাকাটা করবেন না। কেনাকাটার সময় পূর্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চেষ্টা করুন। একজন অভিজ্ঞ ক্রেতা অন্যের সাহায্য ছাড়াই সহজেই নিজের জন্য সঠিক জিনিস কিনতে পারে।