অধ্যাপক ড. অমিত চাকমা ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম উপাচার্য । একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডীয় রাসায়নিক প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ। তিনি ২০০৯ সালে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও-র প্রেসিডেন্ট ও উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ১০ম প্রেসিডেন্ট।
২০১০ সালের ১৯ জুন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলু থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, ২০১৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যালামনাই থেকে আজীবন সম্মাননা এবং ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রী লাভ করেন।
অমিত চাকমার চিন্তাধারা
অমিত চাকমা বলেন, ‘বেশি সময় ধরে ঘরে বসে থাকলে এবং হাঁটাহাঁটিসহ অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ কমিয়ে দিলে আপনার শরীরে ধীরে ধীরে জড়তা আসবে এবং আপনার হাঁটতে কষ্ট হবে। তেমনি আমাদের মস্তিষ্ককে অলস করে রাখলে ওতেও জড়তা ধরবে।
বোঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য শেখার একটি ভিন্ন পদ্ধতিতে যেতে হবে। তখন মুখস্ত করার চেয়েজ্ঞান কাঠামো উপলব্ধি করাই হবে মুখ্য।
সাফল্য অর্জনের জন্য মেধার অনুশীলন প্রয়োজন তো বটেই, কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। সাফল্য অর্জন নিশ্চিত করতে হলে অদম্য প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, আমাদের সবার মস্তিষ্কেও অনেক কিছু শেখার, জানার এবং করার ক্ষমতা আছে। মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিয়েই মেধার বিকাশ করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন চেষ্টা।’
অমিত চাকমার প্রাথমিক জীবন
অমিত চাকমার জন্ম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে এক চাকমা পরিবারে ১৯৫৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৫৭ সালে তার জন্মস্থানের পাশে বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে বাঁধ হওয়ায় তাদের অনেককেই সেখান থেকে চলে যেতে হয়। তার মধ্যে অমিত চাকমার পরিবারও ছিল।
অমিত চাকমার শিক্ষাজীবন
বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি আলজেরীয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে আলজেরিয়ার বিখ্যাত আলজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট ( Institut Algerien du Petrole) এ পড়তে যান। তিনি “রাসায়নিক প্রকৌশল” বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কানাডায় চলে যান মাস্টার্স ও পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য। কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ে এমএএসসি এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
অমিত চাকমার কর্মজীবন
১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারির রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করার পর ১৯৯৬ সালেই ইউনিভার্সিটি অফ রেগিনা-তে চলে যান। সেখানে রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন।
১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত রেগিনার ভাইস-প্রেসিডেন্ট রিসার্চ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে থাকার সময়ই অমিতকে কানাডার “টপ ৪০ আন্ডার ৪০” তে স্থান করে নেন। এরপর ২০০১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলু-র অ্যাকাডেমিক ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং প্রভোস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অমিত চাকমার গবেষণার মূল বিষয় প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকৌশল এবং পেট্রোলিয়াম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ২০০৯ সালের ১লা জুলাই অমিত চাকমা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওর প্রেসিডেন্ট ও উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার আগে এই দায়িত্বে ছিলেন পল ড্যাভেনপোর্ট। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অমিতের লক্ষ্য ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওকে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে পৌঁছে দেয়া।
পুরস্কার ও সম্মাননা
২০১০ সালের ১৯ জুন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলু থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং লাভ করেন। ২০১২ সালে কানাডীয় পোস্ট-সেকেন্ডারি শিক্ষার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ রজত জয়ন্তী পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালে অমিত সেরা ২৫ কানাডীয় অভিবাসী পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৪ সালের ১৪ জুলাই তিনি মাইকেল পি. মেলোনি ইন্টারন্যাশনাল লিডারশিপ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যালামনাই থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রী লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনের বক্তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনের বক্তা ছিলেন তিনি। তার বক্তৃতা সংক্ষেপিত আকারে উল্লেখ করা হলো।
তিনি বলেন, ‘যদিও রাঙামাটির পাহাড়ে আমার জন্ম এবং চাকমা আমার মাতৃভাষা, ছোটবেলা থেকে বাংলা শিখেছি আর বাংলায় পড়াশোনা করেছি। আমার মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। আমার লেখাপড়ার পেছনে আমার মা-বাবার অবদান অতুলনীয়। তাঁদের নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা ও আর্থিক সহায়তা ছাড়া আমার আজ কানাডার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হতো না।
সর্বস্তরের সফল নেতাদের তিন ধরনের উপাদান থাকে: ১. যোগ্যতা, ২. কর্মনিষ্ঠা ও ৩. স্বকীয়তা। যাঁরা নেতৃত্বের পদ অর্জন করেন, যোগ্যতা আর কর্মনিষ্ঠা তাঁদের কমবেশি সবারই থাকে এবং লোকবিশেষে এ দুটোর ব্যবধান খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। স্বকীয়তা হলো এমন একটা গুণ, যা ব্যক্তিভেদে অনেক ব্যবধান হয়। তাই আমি আমার মূল উপদেশ স্বকীয়তার ওপর রাখব।
ডিগ্রি আর মেধাকে কীভাবে কাজে লাগাবেন, তার ওপর নির্ভর করবে আপনাদের সফলতা। আপনাদের মেধাকে ভালো কাজে লাগাতে হবে। আপনাদের মতো মেধাবান যুবক-যুবতীর প্রয়োজন শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সারা বিশ্বের।
যুগ যুগ ধরে মানবজাতি একদিকে যেমন অনেক উন্নতি সাধন করেছে, অন্যদিকে একই সময়ে অনেক বড় আকারের সমস্যারও উৎপত্তি হয়েছে। আপনাদের বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের সমস্যার সমাধান খুঁজতে নিবেদিত হতে হবে। এর জন্য জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। মনে রাখবেন, এই ডিগ্রি প্রাপ্তি আপনাদের শিক্ষাযাত্রার সমাপ্তি নয়, এটা একটা বিশেষ মাইলফলক মাত্র। শিক্ষা একটি আজীবন প্রক্রিয়া।
শিক্ষার মানে শুধু শাস্ত্রজ্ঞান অর্জন নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মনের জানালা খুলে দেওয়া, মনকে বিকশিত আর উন্মুক্ত করা। ইংরেজিতে একটা বচন আছে, ‘মন একটা প্যারাস্যুটের মতো, এটা খোলা থাকলেই সবচেয়ে ভালো কাজ করে।’ গ্রিক দার্শনিক এবং মহান শিক্ষক সক্রেটিসের শিক্ষকতার মূল বিষয় ছিল ভালো আর মন্দের বিশ্লেষণ। তিনি বলেছিলেন, ভালো জিনিস একটাই, তা হলো জ্ঞান। আর মন্দ একটাই, অজ্ঞানতা। সক্রেটিসের সমসাময়িক এই অঞ্চলেরই আরেক দার্শনিক গৌতম বুদ্ধ এক দেশনায় একই বিষয়ে বলেছিলেন, ‘মূর্খকে সেবা করো না, পণ্ডিত ব্যক্তিকে সেবা করো।’
সক্রেটিসের শিক্ষা আর বুদ্ধের দেশনার আড়াই হাজার বছর পরে আমাদের শিক্ষার পরিধি অনেক বেড়েছে। এরই কারণে আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার কথা। বাস্তবে কি তা প্রতিফলিত হয়েছে? ভালো আর মন্দের বিবেচনা শুরু করতে হবে সর্বপ্রথম নিজেকে নিয়ে। সক্রেটিস আরও বলেছিলেন, অপরীক্ষিত জীবন অর্থহীন। যতই বেশি জ্ঞান অর্জন করবেন, ভালো আর মন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা ততই বেশি বাড়বে। সেই অর্জিত জ্ঞানকে যদি সৎ কাজে লাগান, তাহলে আপনাদের স্বকীয়তা আরও বিকশিত হবে। আপনারা তত বেশি নীতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন।
জীবনে সফলতার জন্য ‘ক্যারেক্টারই’ আসল। ক্যারেক্টারের উপর আপনাদের সচেতন হতে হবে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার দৃঢ়বিশ্বাস বিকশিত স্বকীয়তা এবং নীতির ভিত্তিতে ব্যক্তিগত বা কর্মজীবন যত বেশি পরিচালিত করবেন, তত বেশি সফলতা অর্জন করবেন। সর্বদা সত্য কথা বলিবে, চুরি করা মহা পাপ—এই দুটি সংক্ষিপ্ত বাক্যের অর্থ কিন্তু অনেক গভীর। এই দুটি নীতি মেনে চলা নিয়ে যদি শুরু করেন, সেটা হবে স্বকীয়তা গড়ে তোলার এক ভালো সূচনা।
জীবনযাত্রায় আপনারা অনেক অন্যায়ের সম্মুখীন হবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী যুগ যুগ ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আপনারা তাঁদের উত্তরসূরি। তাঁদেরকে আদর্শ বিবেচনা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনাদের সাধ্যমতো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবেন। আবার ফিরে যাই সেই ছোটবেলার শেখা নীতিবাক্যে: অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে। নিজেও কোনো অন্যায় করবেন না, আর অন্যায়কে সহ্যও করবেন না।দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। সাধারণ মানুষের আর সমাজের দুর্বল ব্যক্তিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেবেন না। একদিন আপনারা নেতৃত্বের অবস্থানে যাবেন।মনে রাখবেন, কবিগুরুর অমর বাণী: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।
মনে রাখবেন, আপনারা সবাই সম্মিলিতভাবে জগৎটাকে বদলে দিতে পারেন। আপনারা মেধাবী। আপনাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। মেধা, স্বকীয়তা আর নীতির বলে আপনারা মানব জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবেন। নিজেদের পূর্ণ সম্ভাবনাগুলো অর্জনের চেষ্টা করুন। নিজেকে আবিষ্কার করুন। নিজেকে ছাড়িয়ে যান। উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে দৃঢ়তা আর পরিশ্রম হলো সাফল্যের চাবিকাঠি। বড় বড় স্বপ্ন দেখুন। ছোট থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান।
সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সাফল্যের চাবিকাঠি
অধ্যাপক ড. অমিত চাকমা বলেন, ‘আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। আমি যখন যে কাজটি করেছি তখন তাতে আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ঢেলে দিয়েছি। নিজের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা প্রয়োগ করা যে কোনো সাফল্যের চাবিকাঠি।
অমিত চাকমা ইঞ্জিনিয়ার স্কুল বিল্ডিং
কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একটি ভবনের নাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অমিত চাকমার নামানুসারে অমিত চাকমা ইঞ্জিনিয়ার স্কুল বিল্ডিং অর্থাৎ ‘অমিত চাকমা প্রকৌশল ভবন’ করা হয়েছে। কারণ, কর্তৃপক্ষ মনে করেন, আন্তর্জাতিক কৌশল উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করেছে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশ্ব নাগরিক হতে প্রস্তুত করেছে।
ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর জ্যাক কুইন এবং তার স্ত্রী শ্যারন কুইন ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ অনুদান দিয়ে এই চমৎকার বিল্ডিংটি স্থাপন করেন এবং তা অমিত চাকমাকে উৎসর্গ করেন।
তথ্যসূত্র
prothomalo.com
www.ittefaq.com.bd
bn.wikipedia.org
www.sbs.com.au
www.jagonews24.com
bangla.bdnews24.com
www.bd-pratidin.com