স্ক্রিন আসক্তিতে বিপদ বাড়ছে। আসক্তরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কেউ কেউ আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিচ্ছে।ফলে স্ক্রিন আসক্ত সন্তানের বাবা-মা সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। কারণ অনেক বাচ্চারা চিনি বা মিষ্টির চাইতেও এসব স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে। অনেক শিশুরা বাইরে খেলাধুলার চাইতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে।
স্ক্রিন আসক্তি কী?
চিকিৎসা শাস্ত্রে আসক্তি বলতে বোঝায়, কোনো বস্তুর প্রতি মানুষের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, এবং এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করা।মানুষ যখন কোনও বস্তুর দ্বারা আচ্ছন্ন বা বশবর্তী হয়ে যায়, তখন তার কাছে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি যেমন,পরিবার,বন্ধুবান্ধব এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সবই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।এর ফলে সেই মানুষটি যেমন সমস্যায় পড়ে,তেমন তার চারপাশে থাকা মানুষরাও নানা অসুবিধার সম্মুখীন হন।
সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজের মতো টেকনোলজি অ্যাডিকশনও মানুষের একপ্রকার আচরণগত সমস্যা এবং নিজেকে বাস্তব বা সমাজ থেকে সরিয়ে রাখার মানসিকতাও এর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অন্যান্য আসক্তির মতোই প্রযুক্তির প্রতি আসক্তিও মানুষের একধরনের অভ্যাস। যখন কেউ এই অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে না, তখনই তা একজন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কুপ্রভাব ফেলে।
অভিভাবকরা কী করতে পারেন?
বাসায় নিয়ম চালু করে সময় বেধে দিতে হবে যে, বাচ্চারা কতটা সময় এসব মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার দেখতে পারবে। অনলাইন বা ইন্টারনেটে শিশুরা কি কি দেখতে পারবে সে বিষয় সম্পর্কে তাদেরকে বোঝাতে হবে। অনলাইন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগে তাদের উৎসাহ দিতে হবে।
শিশুদের শেখাতে হবে কোনো কিছুতে ক্লিক করার আগে যেন তারা ভেবে দেখে যে সে কী দেখতে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত বিষয় দেখায় সীমাবদ্ধতা আনতে প্রযুক্তিগত কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করার ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করুন। আর সন্তানের জন্যে এ ব্যাপারে ভালো নিজেকে ভালো উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।
বিকল্প দিন
সন্তানের যে কাজে মনোযোগ তাকে সেটি করতে দিন। নাচ, গান বা খেলাধুলা যা সে করতে চায়, তা করার জন্য উৎসাহ দিন। তাহলে স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তি কমতে শুরু করবে। যে সময়টি যে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে কাটায়; এর বিকল্প কিছু করানোর চেষ্টা করুন। রাস্তায় হাঁটছেন বা টয়লেটে — কিছুতেই কি চোখ সরাতে পারেন না মোবাইলের স্ক্রিন থেকে? রাতে শুতে যাবার সময় ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ চেক না করলে কি ঘুম আসে না ? এই নেশা কাটানোর কয়েকটি উপায় হচ্ছে-
কাজ থেকে বাড়িতে ফেরার পরে মোবাইলটিকে সাইলেন্ট করে দিন। খুব প্রয়োজন না থাকলে ফোনটিকে কোনো ড্রয়ার বা আলমারিতে রেখে দিন। আধ ঘন্টা বা এক ঘন্টা পরে ফোন বার করে দেখুন ইতোমধ্যে কোনো জরুরি ফোন বা মেসেজ এসেছে কি না। অফিসে থাকাকালীন টয়লেট যেতে হলে মোবাইলটিকে রেখে যান নিজের ডেস্কে।
আপনি যখন রাস্তায়, তখন নিজের চারপাশের পরিবেশের দিকে মনোযোগ দিন। আর রাস্তা পেরনোর সময়ে অবশ্যই তাকান ট্র্যাফিক সিগনালের দিকে। দিনে অন্তত ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন বা অন্য কোনো মেন্টাল রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজের জন্য নির্ধারিত রাখুন। মোবাইল ফোন দৃষ্টির বাইরে রাখলে তার প্রভাবও কম পড়ে। তাই ফোনটি লুকিয়ে রাখুন।
দৃষ্টান্ত তৈরি করুন
টিভি আসক্তি দ্রুত হারে বাড়ছে। শিশুদের আসক্তি দূরীকরণে প্রথমে টিভি দেখার নেশা বাবা-মার থাকলে সেটা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে ফেলতে হবে। শিশুর সামনে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। সে-ও যেন বোঝে যে, কোনো প্রিয় অনুষ্ঠান দেখা সহজেই ছেড়ে দেয়া সম্ভব। সন্তানকে টিভি দেখার সময় নির্দিষ্ট করে দিন। বেছে দিন এমন কিছু শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান, যা সন্তানের সঙ্গে বসে দেখতে পারেন।
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
সন্তানকে বাইরে বের হওয়ার ও খেলাধুলা করার সুযোগ দিন। আসক্ত হওয়ার মতো অবসর যেন তার না থাকে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে শিশুকে ছোটবেলা থেকেই বই উপহার দিন ও পড়তে উৎসাহিত করুন। নিজেও পড়ার সময় বের করুন। প্রয়োজনে একই বই একসঙ্গে বসে পড়ুন।
কোয়ালিটি টাইম দিন
সন্তানের জন্যে বরাদ্দ সময়ে অন্য কোনো কাজ করবেন না। ওর সঙ্গে খেলুন বা ওকে নিয়ে কাছের পার্কে/ জাদুঘরে/ মনোরম স্থানে বেড়াতে যান। সন্তানকে প্রযুক্তি আসক্তি থেকে মুক্ত করতে বকাঝকা নয়, উদ্বুদ্ধ করুন। সন্তানকে কোয়ালিটি সময় দিন এবং ভালো বন্ধু হোন। কোয়ালিটি টাইম হলো সন্তানের প্রতি নিরবচ্ছিন্নভাবে মনোযোগ দিয়ে তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু সময় কাটানো।
প্রযুক্তি বিষয়ে সঠিক ধারণা দিন
নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস অনুসারে সন্তানকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিন। নিজেও অনুশীলন করুন। সন্তানদের প্রযুক্তি বিষয়ে সঠিক ধারণা দিতে নিজেও প্রযুক্তির ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা রাখুন। সন্তানের রোল মডেল হতে নিজেও ভার্চুয়াল আসক্তি থেকে দূরে থাকুন। শিশুর নাগালে স্মার্ট টিভির রিমোট কন্ট্রোল রাখবেন না।
সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করুন
সন্তানকে সৃজনশীল ও সেবামূলক কাজে উৎসাহিত করুন। পছন্দের সৃজনশীল বিষয় শেখাতে ভর্তি করুন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। বয়স অনুযায়ী সন্তানকে ঘরের কাজে সম্পৃক্ত করুন। ভাইবোনের সাথে সবকিছু শেয়ার করতে শেখান। তাহলে সে আত্মকেন্দ্রিকতা মুক্ত হবে।
সন্তানকে ভার্চুয়াল গেম খেলতে না দিয়ে ঘাম ঝরানোর মতো খেলা মাঠে গিয়ে দলবদ্ধভাবে খেলতে উৎসাহিত করুন। এতে তার একাকিত্ব কাটবে, অবসন্নতা কমবে, সহনশীলতা এবং সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা বাড়বে। বাসায় স্মার্টফোন কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ কমান। ১৮ বছরের আগে সন্তানের হাতে একান্ত যোগাযোগের প্রয়োজনে সাধারণ মোবাইল ফোন দিতে পারেন।
সন্তানকে স্মার্টফোন নয়, সময় দিন
বাবা-মা ব্যস্ত থাকেন চাকরি বা ব্যবসার কাজে। কিছু বাবা-মা তার চঞ্চল শিশুকে অন্য কোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অগত্যা মোবাইল দিয়ে বসিয়ে দেন। আবার অনেক মা তার সন্তান খেতে না চাওয়ায় মোবাইল ফোন দেখতে দেন। তারা ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে, কার্টুন দেখতে দেখতে খায়। সুতরাং অভিভাবক নিশ্চিন্ত হন অর্থাৎ বিনা ঝামেলায় বাচ্চারা এখন পেটপুরে খায়।
এভাবেই বাবা-মায়েরা সন্তানকে শান্ত রাখতে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোনসহ নানা ধরনের দামি ট্যাব। এতে একদিকে যেমন বাবা-মায়েরা নিশ্চিন্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি তারা এটাকে আভিজাত্যের অংশ মনে করেন। আর এভাবে সন্তানকে ভালোবেসে সন্তানের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা নিজেদের অজান্তেই করে যাচ্ছেন বাবা-মা।
বাবা-মা কী করবেন? কী করবেন না?
মা বাবার প্রযুক্তি ব্যবহার সন্তানের আচরণকে প্রভাবিত করে। সন্তানের জন্য বাবা মা রোল মডেল বা আদর্শ অনুকরণীয় হতে পারেন। সন্তান যাতে যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার ছাড়াই খেতে পারে, সময় কাটাতে পারে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাবা-মায়ের। সন্তানকে খাওয়ার সময় স্ক্রিন থেকে দূরে রাখার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন :
সন্তানের জন্য রোল মডেল হোন
সন্তান সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে বাবা-মার আচরণে। সন্তানকে স্ক্রিন থেকে দূরে রাখতে চাইলে সবার আগে এটা নিশ্চিত করুন যে বাবা-মা খাওয়ার সময় টেলিভিশনের সামনে বসছেন না বা মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে কাজ করছেন না। পুরো পরিবারেই এটি নিশ্চিত করতে হবে যে কেউ খাওয়ার সময় স্ক্রিনের সামনে বসছে না। শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়। তারা যদি দেখে যে পরিবারের কেউই খাওয়ার সময় স্ক্রিনের সামনে বসে না, তাহলে আশা করা যায় যে তারাও এমন টা করবে না।
খাওয়ার সময়টা উপভোগ্য করে তুলুন
খাওয়ার সময় চেষ্টা করুন যাতে পরিবারের সবাই একসাথে খাবার খেতে পারেন। খাওয়ার সময়টা শুধুমাত্র খাওয়া এবং কিছু পারিবারিক আলাপের জন্য। এই সময় নিজেরা সারাদিন কে কি করলেন সেই গল্প শুনুন, হাসি ঠাট্টা করুন। একটা আনন্দময় এবং উপভোগ্য পরিবেশ তৈরি করুন।
আর অবশ্যই এই গল্পে আপনার সন্তানকেও যুক্ত করুন। তার কথা শুনুন, সে সারাদিন কি করেছে, তার কোনো মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা এসব শুনুন। এতে করে আপনার সন্তানের নিজ পরিবার সম্পর্কে ভালো ধারণা হবে, পাশাপাশি সে নিজেকেও পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে গণ্য করবে। সত্যি বলতে এটা নিশ্চিত করা গেলে আর স্ক্রিন ব্যবহারের চিন্তাও আসার কথা না।
রুটিন মেনে চলুন এবং পুষ্টিকর খাবার খান
প্রতিদিন অবশ্যই নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া করবেন। যেমন একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিদিন সকাল এবং বিকালের নাস্তা এবং দুপুর ও রাতের খাবার খাবে। আর খাবার মেন্যুতে পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার রাখবেন। এতে করে আপনার সন্তানের সুষম খাদ্যাভ্যাস তৈরি হবে, পাশাপাশি সে একটা নিয়মের ভেতর চলে আসবে। যার কারণে খাওয়ার সময় স্ক্রিন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের চিন্তা আসবে না তার।
খাবারকে উপভোগ্য করে তুলুন
কি মেন্যু তৈরি করবেন, সেই পরিকল্পনাতে সন্তানকেও অন্তর্ভুক্ত করুন। তার মতামত নিন। সে কি খেতে চাই জিজ্ঞেস করুন। তার পছন্দের অন্তত একটি খাবার মেন্যুতে রাখুন। আর যখন আপনি খাবার বানাবেন তখন তাকেও সেখানে রাখুন। তাকে বলুন এটা সেটা এগিয়ে দিতে।
তাছাড়া যখন বাজার করতে যাবেন বা কোনো ফলমূল কিনতে যাবেন তখন সন্তানকেও সাথে নিন। এসব কিছুর কারণে আপনার সন্তানের খাবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে। তখন সে খাবার কে মন থেকে উপভোগ করতে চাইবে। এতে সে কোনো রকম স্ক্রিন ব্যবহার ছাড়াই ভালো মতো খেতে পারবে।
খাওয়ার জন্য জোর করবেন না
বেশিরভাগ মা বাবাই সন্তান খেতে না চাইলে জোর করে খেতে বাধ্য করেন। এটি সন্তানের জন্য মোটেও ভালো কিছু নয়। সন্তানকে কোনো রকম চাপ ছাড়াই খেতে দিন। বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানোর কুফল অনেক।
প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ড. লরা মার্কহাম সন্তানকে খাওয়ার জন্য কোনো রকম জোর জবরদস্তি না করার পরামর্শ দিয়েছেন। সে যেটুক খেতে পারে সেটুকই খাক। তার যদি পরে ক্ষুধা লাগে, সে নিজ থেকেই চেয়ে খাবে। আজ কোনোl সবজি খেতে চাচ্ছে না, জোর করার দরকার নেই। অন্য সময় দিবেন।
এতে করে সন্তানের খাবারের প্রতি কোনো রকম বিরক্তিবোধ আসবে না। মনে রাখবেন খাবারের প্রতি উৎসাহী না হওয়া এবং বিরক্তিই কিন্তু সন্তানের খেতে না চাওয়া এবং স্ক্রীন দেখে খাওয়ার অন্যতম কারণ।
ধীরে ধীরে বদভ্যাস থেকে বের করা
যদি সন্তান ইতিমধ্যে খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহারে আসক্ত হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে ধীরে ধীরে এই বদভ্যাস থেকে বের করে নিয়ে আসা। অনেক শিশুই স্ক্রিন দেখা ছাড়া খেতে চায় না। এটি নিয়ে মা-বাবারা প্রায়শই চিন্তিত থাকেন যে কিভাবে এই বদভ্যাস পরিবর্তন হবে, কি করলে তারা স্ক্রিন ছাড়াই খেতে শিখবে।
এই ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ফ্রান্সিস বলেন, বর্তমানে বাচ্চারা সপ্তাহে প্রায় ২০ ঘন্টার বেশি স্ক্রিনের সামনে থাকে। তাই তাদের এই আসক্তি দূর করা কিছুটা কঠিন হবে। তবে অসম্ভব না। পরিবারের সদস্যরা যখন বুঝবে যে খাওয়ার সময়টা শুধুই পারিবারিক খোশগল্পের জন্য, তখন তারা সেটা যেকোনো ভাবে সম্ভব করেই ছাড়বে। এজন্য পরিবারের বড়দের আগে এই উপলব্ধি আসতে হবে।
সিদ্ধান্ত নিন এবং বন্ধ করুন
সন্তানকে খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহার করতে দিবেন না। সন্তান যতোই রাগারাগি করুক, কান্নাকাটি করুক, জেদ করুক আপনি কোনো ভাবেই তাকে স্ক্রিনের সামনে বসতে দিবেন না। হয়তো একদিন দুইদিন সে খুব জেদ করবে, কিন্তু আস্তে আস্তে এটার সাথেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাকে কোনো রকম বকাবকি বা শাসন করার দরকার নেই, শুধু খাওয়ার সময় স্ক্রিন দিবেন না।
নিজের নীতিতে অটল থাকুন
সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিজের নীতিতে অটল থাকা। আপনার সন্তান যা ই করুক, আপনি কোনো ভাবেই তাকে স্ক্রিনের সামনে বসে খেতে দিবেন না। আজকে করলেন, কিন্তু কালকে কান্নাকাটি বেশি করছে দেখে আবার স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দিলেন, তাহলে হবে না। আপনাকে ধারাবাহিক ভাবে নিজের নীতি মেনে চলতে হবে। বাচ্চা সাময়িক কষ্ট পেলেও এটি পরবর্তীতে খুবই উপকারী হবে।
খাবারের আগে স্ক্রিন সরিয়ে ফেলা
এটি খুব জরুরি বিষয়। আপনার সন্তান যদি আশে পাশে স্ক্রিন দেখে তাহলে সে আরো বেশি জেদ করবে, আরো বেশি রাগারাগি করবে। তাই খাওয়ার সময় আশেপাশে কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা স্ক্রিন রাখবেন না। যেই রুমে টেলিভিশন সেই রুমে বাচ্চাকে খাওয়াবেন না। মোদ্দকথা আপনার সন্তানের ত্রিসীমানায় যেনো কোনো রকম স্ক্রিন না থাকে।
শিশুকে তার পছন্দের খাবার দেয়া
এই সময়টা আপনার সন্তানকে নতুন কোনো শাকসবজির সাথে পরিচয় করানোর সময় নয়। এই সময় তাকে তার পছন্দের খাবারগুলো দিন। এমন নয় যে জাঙ্কফুড হতে হবে। এমন কিছু মেন্যুতে রাখুন যা সে পছন্দ করে। কোনো রকম আপত্তি ছাড়া খুশি মনেই খাবে এমন খাবার রাখুন। আশা করা যায় যে এই পদ্ধতি বেশ উপকারী হবে।
খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিন
সত্যি বলতে খাওয়ার সময় খেলনা দেওয়া টা উচিত নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনি এটা করতে পারেন। তাকে কিছু খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিলেন বা সে খেলছে এমন অবস্থায় তাকে খাইয়ে দিতে পারেন। বাচ্চাদের সব সময়ই খেলনার প্রতি আলাদা ঝোঁক থাকে। তাই এই পদ্ধতিটিও বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
খাওয়ার সময় স্ক্রিন ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে দিন
যদি এই পদ্ধতি ঠিকঠাক মতো কাজে লাগাতে পারেন তবে আশা করা যায় যে, আপনার সন্তান অতি শীঘ্রই স্ক্রিন ছাড়াই খেতে শিখবে। এই ক্ষেত্রে আপনি একদিন তাকে তার পছন্দের খাবার গুলো বানিয়ে দিন। আর তাকে বলুন যে সেটা খাবার টেবিলে বসেই খেতে। প্রিয় খাবার দেখে সে টেবিলে বসে খেতে আপত্তি করবে না। সাধারণত যে সময় সে খাবার খায়, তার কিছুক্ষণ আগেই দিন। এভাবে কয়েকদিন চেষ্টা করুন। আস্তে আস্তে এটাকেই অভ্যাস বানিয়ে ফেলুন।
স্ক্রিন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিন
এটি শুধু আপনার শিশু সন্তানের জন্য নয়, পরিবারের সব সদস্যদের জন্যই স্ক্রিন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিন। পরিবারের কোনো সদস্য যেন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওই নির্ধারিত সময় ব্যতিত স্ক্রিন ব্যবহার না করে। আপনার সন্তান যদি দেখে যে পুরো পরিবার এটা অনুসরণ করছে, তাহলে সে অনিচ্ছা থাকলেও এই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য হবে।
আপনি আরেকটা কাজ করতে পারেন যে এই পুরো ব্যাপারটা আপনার শিশু সন্তানকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিতে পারেন। এতে করে সে নিজেও নির্ধারিত সময় ছাড়া স্ক্রিন ব্যবহার করবে না, পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করবে যে বাড়ির সবাই এই নিয়ম মেনে চলছে।
পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন
ছোট শিশুরা সব সময়ই বিভিন্ন উপহার বা পুরস্কার পেতে পছন্দ করে। আপনি তাকে বলতে পারেন যে আজকে স্ক্রিন না দেখে খেলে তাকে কোন উপহার দেবেন বা পরের দিন কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবেন। ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এসব ম্যাজিকের মতো কাজ করে। ধীরে ধীরে একটা সময় সে স্ক্রিন ছাড়াই খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
নিয়মিত খেলাধূলা করতে দিন
একটা সময় ছোট বাচ্চারা ঘরের বাইরে খেলতে দিতে না দিলে কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আজকাল প্রায় সবাই স্ক্রিন নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে তাদের বাইরে খেলতে যাওয়ার সুযোগ ই হয় না। বাবা মা দের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তাদের সন্তান বাইরে খেলতে যাচ্ছে।
বাইরের খোলা হাওয়া, মুক্ত বাতাস আপনার সন্তানকে চাপমুক্ত এবং উৎফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া খেলাধূলা করলে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলাও ঠিক মতো কাজ করে। আর প্রচুর পরিশ্রমে বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের ক্ষুধা লেগে যায়। আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকলে তারা কোনো রকম স্ক্রিন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছাড়া অনায়াসেই খাবে।
এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী আরতি রাজরত্নম বলেন, “ বাবা মা দের উচিত এটা নিশ্চিত করা যে তাদের সন্তান নিয়মিত খেলাধূলা করছে। কারণ খেলাধূলা করলে তারা ক্ষুধার্ত হবে। আর তখন কোনো রকম গ্যাজেট বা স্ক্রিন ছাড়াই খাবে তারা”। এজন্য মা বাবা দের উচিত তাদের সন্তানকে নিয়মিত খেলাধূলা করতে পাঠানো।
সন্তানের সাথে গল্প করুন
এসব কিছুর পাশাপাশি একটা কাজ অবশ্যই করবেন। সেটা হচ্ছে আপনার সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। তার কথা শুনুন, তার সাথে গল্প করুন। আপনার ছোটবেলার গল্প তার সাথে শেয়ার করুন। দেখবেন সে আর স্ক্রিনের কথা মনেই আনছে না, আপনার কথা অনুযায়ীই চলছে। এজন্য আপনার সন্তান যেন আপনার পূর্ণ মনোযোগ পায়, সেটা নিশ্চিত করুন।
মা বাবারাও মানুষ। তাদের ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কখনো কখনো তাদের শরীর খারাপ থাকলে বা কোনো জরুরি কাজ থাকলে তারা হয়তো সন্তানকে দ্রুত খেয়ে নেওয়ার জন্য স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত করবেন যে এটা শুধু ওইদিন এর জন্যই, আপনার বাচ্চা যেন এটাকে নিত্যদিনের সঙ্গী ভেবে না নেয়। আশা করছি আপনার সন্তান স্ক্রিন দেখা ছাড়াই খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে।
কেন স্ক্রিন আসক্তি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ?
অতিরিক্ত সময় কোনও ইলেকট্রনিক ডিভাইসে লগ ইন হয়ে থাকার অনেক সমস্যা আছে। তীব্র আলোর চোখধাঁধানিতে ঘুম আসবে না চট করে, মুখে বলিরেখা পড়বে তাড়াতাড়ি, ড্রাই আই সিনড্রোম বাড়তে পারে। বাচ্চার অডিয়ো ভিস্যুয়ালে অতিরিক্ত আসক্তি তৈরি গেলে সে আর পরে স্বাভাবিক বই-খাতার পড়াশোনায় ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ। বড়োদের ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, তা হচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় থাকতে গিয়ে আমরা আশপাশের মানুষের থেকে বড্ড দূরে সরে যাই এবং তা টের পেতেও অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই আজ থেকে রাশ টানুন অতিরিক্ত গ্যাজেট ব্যবহারে, জীবনে ফিরিয়ে আনুন পুরোনো ছন্দ।
বিষণ্নতা বাড়ছে
পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। বাচ্চাদের পড়াশোনা ও বিনোদন এবং বাসা থেকে অফিসের কাজ পরিচালনার জন্যও অনেকে ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কিন্তু বিরামহীন ভার্চুয়াল যোগাযোগের ফলে মানুষের মাঝে এক ধরনের বিষণ্নতা কাজ করছে। এর ফলে ব্যক্তি জুম অবসাদে ভুগছে।
দীর্ঘ অবসাদ তৈরি হচ্ছে
কোনো ধরনের বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় বৈঠকের মাঝে ব্যক্তিরা মানসিক চাপে পড়ে। স্ক্রিন থেকে শারীরিকভাবে বিরতি নেয়াটা অত্যন্ত জরুরি। এর ফলে আমাদের মনোযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দিনের যে সময়টুকুতে অবসর পাওয়া যায় সে সময়টুকু ফোন অথবা অন্যান্য ইলেকট্রনক ডিভাইস থেকে দূরে থাকা উচিত। এটি ব্যক্তিকে সোস্যাল মিডিয়া আসক্তি থেকে মুক্তি দিতে অনেকটা সহায়তা করে। মাত্রাতিরিক্ত ডিভাইস আসক্তি হয়তো সাময়িকভাবে বিনোদন দিতে পারে, তবে এটি দীর্ঘ অবসাদ তৈরি করে।
সৃজনশীলতায় ব্যাঘাত ঘটছে
ফোন ও বিভিন্ন ভার্চুয়াল নোটিফিকেশন ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীলতায় ব্যাঘাত ঘটায়। ক্রমাগত ভার্চুয়াল নোটিফিকেশন ব্যক্তিকে ভুল ও অবসাদের দিকে ধাবিত করে। অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সাবেক নির্বাহী সহকারী নাজ বেহেস্তি বলেন, যদি আমরা আমাদের আচরণের প্রতি মনোযোগ দিই এবং একটি সঠিক সীমানা ও সময়সূচি নির্ধারণ করি, তাহলে প্রযুক্তিকে আমরা আমাদের প্রতিকূলের পরিবর্তে অনুকূলে ব্যবহার করতে পারব।
স্বপ্ন পূরণে অন্তরায়
স্ক্রিন আসক্তি ও অনিদ্রা স্বপ্ন পূরণে অন্তরায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরের এক ঘণ্টা এবং রাতে শুতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে সমস্ত ডিভাইস থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিন। এক-আধদিন রাত পর্যন্ত মিটিং চলতেই পারে, সেটা আলাদা প্রশ্ন। ভিডিয়ো গেম নয়, প্রতিদিন নিয়ম করে খানিক্ষণ বাচ্চার সঙ্গে খেলাধুলো করুন, তার হোমওয়ার্কের সময় সাহায্য করুন। ছোটো ছোটো পরিবর্তন আনুন জীবনে, তাতেই জীবন সহনীয় হয়ে উঠবে।
অনিদ্রা বাড়াচ্ছে
ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা একটি ঘুমের ব্যাধি। এটি ব্যক্তির ভাল ঘুমকে নষ্ঠ করে এবং ব্যক্তি সারা রাত ঘুমাতে পারে না। অথচ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য একটি বিষয় হলো ঘুম। ক্লান্তি ভুলে পূর্ণোদ্যমে কাজ করার জন্য ঘুম আবশ্যক। স্ক্রিন আসক্তির ফলে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের অধিকাংশই ইনসোমনিয়ায় ভুগছে। তাদের সারারাত জেগে চলে ফেইসবুকের নিউজফিড স্ক্রলিং, চ্যাটিং, গেমিং কিংবা মুভি দেখা। পাখির কিচিরমিচির কিংবা মুয়াজ্জিনের আযান শুনে যেখানে তাদের ঘুম ভাঙার কথা, সেখানে তারা তখন যাচ্ছে ঘুমোতে।
একজন মানুষকে সুস্থ থাকার জন্য রোজ ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন।কিন্তু তারা মোটে ঘুমোয় ৩-৪ ঘন্টা।ভোর ৫ টায় ঘুমিয়ে সকাল বেলার ক্লাস কিংবা কাজের চাপে সকাল ৭-৮ টায় বিছানা ছাড়তে হয়।ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যই মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়াটাও একটি বিরাট সমস্যা এবং জটিল আকার ধারণ করছে।
স্মৃতিশক্তি লোপ পায়
স্ত্রিন আসক্তি নিদ্রার মতো স্বর্গসুখটাও তারা হারিয়ে ফেলে। রাত জাগার ফলে শরীরের বহুমাত্রিক সমস্যা হয়। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে টানা ২-৩ দিন ঠিক করে না ঘুমালে শরীরের অন্দরে এমন কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে যে তার প্রভাবে রক্তচাপ বাড়তে শুরু করে। টানা কয়েকদিন ৬ ঘন্টার থেকে কম সময় ঘুমালে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কারণ ঘুম কম হলে নরমালি ক্ষুধা বাড়তে থাকে। বেশি মাত্রায় খেলে স্বভাবতই ওজন বাড়ে।
আর ওজন যখন মাত্রা ছাড়ায়, তখন একে একে শরীরে এসে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের মতো নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ। আমরা যখন ঘুমোই তখন আমাদের মস্তিষ্ক নিজেকে রিজুভিনেট করতে থাকে। সেই সঙ্গে সারা দিন ধরে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এবং তথ্য ব্রেনে স্টোর করার কাজটাও এই সময় ঘটে থাকে। তাই তো ঠিক মতো ঘুম না হলে প্রথমেই স্মৃতিশক্তির উপর প্রভাব পরে। সেই সঙ্গে কগনিটিভ ফাংশন কমে যাওয়ার কারণে মনোযোগ এবং বুদ্ধি কমে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলিও ঘটে থাকে। সে সাথে মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা হারিয়ে যায়।
মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যায়
যারা ৫ ঘন্টা বা তার কম সময় ঘুমায়, তাদের হঠাৎ করে মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষদের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। দিনের পর দিন ঠিক মতো ঘুম না হলে ধীরে ধীরে মস্তিকের অন্দরে ফিল গুড হরমোনের ক্ষরণ কমে যেতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটির মতো সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। একাধিক কেস স্টাডিতে দেখা গেছে মাসের পর মাস ঠিক মতো ঘুম না হলে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু অংশ এতটাই ক্লান্ত হয়ে পরে যে ঠিক মতো কাজ করে উঠতে পারে না। ফলে কম সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ঘুমের সঙ্গে হার্টের স্বাস্থ্যের সরাসরি যোগ রয়েছে। স্ক্রিন থেকে বের হওয়া গামা রশ্মি চোখের সুস্থতা কেড়ে নেয়।
স্ক্রিন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস
শিশুদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাসের জন্য স্ক্রিনের অতিরিক্ত ব্যবহার দায়ী। পাঁচ থেকে ছয় বছরের শিশু যারা স্ক্রিনে বেশি সময় দেই তারা শাকসবজি ফলমূল কম খায়, আর চকলেট, চিপস, জাঙ্কফুড এই জাতীয় জিনিস খেতে বেশি পছন্দ করে।
যখন তারা স্ক্রিন ব্যবহারে মগ্ন থাকে তখন তারা ধীরে ধীরে আগ্রহহীন ভাবে খেতে থাকে। স্ক্রিনের দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ থাকার কারণে তারা কি কম খাচ্ছে না বেশি খাচ্ছে সে খেয়াল তাদের থাকে না। যার ফলে তাদের শারীরিক কার্যকলাপ ও ব্যাহত হয়। এর ফলে স্থূলতা বা ক্ষুধামন্দার মতো রোগ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া সঠিকভাবে খাবার না চিবালে বা অমনোযোগী হয়ে গিলে ফেললে খাবার হজমে সমস্যা হয়। সেই ক্ষেত্রে বদহজমের মতো সমস্যা ও হতে পারে।
অনেক বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে অথবা না চিবিয়ে সরাসরি গিলে ফেলে। এগুলোও স্ক্রীন আসক্তির ফল, কারণ সে জানেই না কিভাবে খাবার খেতে হয় বা খাবারকে উপভোগ করতে হয়। খাওয়ার সময় স্ক্রিন দেখাটা অভ্যাস হয়ে গেলে এটি তাদের দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হবে। আর দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাস হয়ে গেলে এটি সহজে ছাড়ানো সম্ভব হবে না। তাছাড়া স্ক্রিনের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের জন্য ভয়াবহ নেশা হয়ে যেতে পারে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন রকম নেতিবাচক কাজের সাথেও জড়িয়ে পড়তে পারে।
প্যারেন্টিং বিশেষজ্ঞ ড. লরা মার্কহাম বলেন, খাওয়ার সময় কখনোই শিশুকে স্ক্রিন ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ এতে করে সে কি খাচ্ছে, কি চিবাচ্ছে তা সম্পর্কে অবগত থাকে না এবং তার শরীরের প্রয়োজন মিটে গেছে কিনা সেটাও তার বুঝতে পারেনা। যখন থেকেই তার নিজ হাতে খেতে সক্ষম হয়ে ওঠে তখন থেকেই তাদের নিজে খাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া উচিত এবং খাওয়ার জন্য কখনোই জোর করা উচিত নয়। খিদে পেলে সে নিজেই খাওয়া শিখে নেবে।
গুরুতর আসক্তি সৃষ্টি
৯০% শিশুরা দুই বছর হওয়ার আগেই ইলেকট্রনিক ডিভাইস এর সাথে পরিচিত হয়ে যায়। অথচ এই বয়সেই শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সবচাইতে বেশি হয়। এ সময় ডিভাইসের ব্যবহার মস্তিস্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।
যোগাযোগ কমে যাওয়া
আধুনিক পরিবার গুলোতে সবাই একসাথে খাওয়া বিষয়টা খুব কমই দেখা যায়। শিশুরাও খাওয়ার সময় টেলিভিশন বা ইউটিউবে কার্টুন বা অন্য কিছু দেখতে দেখতে খেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু এটি খুবই খারাপ অভ্যাস। কারণ খাবার টেবিলেই পরিবারের সবাই একসাথে হওয়া হয়, পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
এটি করা না হলে সন্তানের নিজের পরিবার সম্পর্কে খারাপ ধারণা চলে আসে। নিজের পরিবারের লোকদের সাথে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যার কারণে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান বা পরিবারের সবাই একসাথে কোথাও খেতে বা ঘুরতে যেতে চাইলে তারা সেখানে অংশগ্রহণ করতে চায় না। আর করলেও নিজেদের আড়াল করে রাখতে চায়। যার ফলে ভবিষ্যতে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশে স্ক্রিন আসক্তির পরিস্থিতি
বাংলাদেশে সাধারণত ১৪ থেকে ১৯ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েদের এই ধরনের নেশায় আচ্ছন্ন হতে দেখা যায়। কারণ এরাই অতিরিক্ত পরিমাণে মোবাইল, কম্পিউটার,সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত।সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম এই প্রযুক্তিগুলোর ভালো ও মন্দ দিক সম্পর্কে সম্যকরূপে ধারণা রাখেনা।তাই তারা এর ভালো দিকটা বাদ দিয়ে চকচকে রঙিন মন্দ দিকটাই বেছে নিচ্ছে।
দুনিয়ার অন্যান্য দেশের তরুণরা যেখানে প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করে বিভিন্ন প্রোডাক্টিভ কাজ করছে সেখানে আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ টিকটক ও লাইকি জাতীয় আনপ্রোডাক্টিভ সামাজিক মাধ্যমে তাদের সোনালী সময় নষ্ট করছে।বর্তমান সময় খেলার মাঠ কমে গেছে।তাই অনেক ছেলেমেয়েরা অনলাইন গেম খেলছে ঘন্টার পর ঘন্টা,যা হয়ে গেছে একটা প্রত্যাহিক রুটিনের মতো।
প্রযুক্তির ব্যবহার যেখানে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা জরুরি,তা আমাদের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেয়ে উলটো আমাদেরই নিয়ন্ত্রণ করছে। নতুন প্রজন্মকে এই স্ক্রিন আসক্তি ও নিদ্রাহীনতার ভয়াল থাবা থেকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। নয়তো দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে। আগামীর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে শীর উঁচু করে দাঁড়ানোর পরিবর্তে মুখ থুবড়ে পড়বে।
স্ক্রিন আসক্তি দূরীকরণের উপায়
মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে কীভাবে শিশুর চোখ ফেরানো যাবে- এনিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এখনকার বাবা-মায়েদের বড় দুশ্চিন্তা তাদের ছেলে-মেয়েরা খুব বেশি মোবাইল ফোন, ট্যাব বা কম্পিউটার ব্যবহারে আসক্ত ।
অনেক বাবা-মা মনে করছেন- মোবাইল বা কম্পিউটারের কারণে তাদের সন্তানদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। এসব ফোন বা ট্যাবলেট শিশুদের সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতায় প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাসে নিয়ন্ত্রণ আনার ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ।
বাবা-মায়েরা নিজেরাই অনেক ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্তানদের জন্যে একটা খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করছে। সন্তানদের স্ক্রীন আসক্তি থেকে রক্ষা করা এবং স্ক্রীনটাইমকে তাদের বিকাশে কাজে লাগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায় স্ক্রিন আসক্তি দূরীকরণের উপায় হচ্ছে-
শরীরের ক্ষতি বুঝুন ও বুঝান
হাতে মোবাইল ফোনসহ ইলেকট্রনিক্স ট্যাব বা গেজেট দেওয়ায় নানা রোগের জন্ম হয় শিশুদের শরীরে। মোবাইলে প্রচুর কথা বলার কারণে কানের নানা সমস্যা হচ্ছে। শিশুরা মোবাইলে আসক্তি হওয়ার কারণে চোখের সমস্যা হচ্ছে। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশুরা দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম খেলে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়ে।
সৃজনশীল নানা ধরনের খেলা
শিশুরা প্রচণ্ডভাবে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে শিশুদের সামাজিক আচার-আচরণের ছন্দপতন ঘটছে। শিশুদের অতিরিক্ত ফোন আসক্তির কারণে শিশু পরিবারের সঙ্গে গল্প-গুজব করা, সাহায্যের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া, সবার সঙ্গে মিশতে পারার দক্ষতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে।
গ্রামীণ শিশুরা ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তেমন সক্রিয় না পাওয়ায় অ্যাপস ডাউনলোড সবসময় না করতে পারলেও মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেইম খেলে, গান শোনে, কার্টুন দেখে। শহরে খেলার মাঠের সংকট থাকায় শিশুরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা সৃজনশীল নানা ধরনের খেলার মাধ্যমে শিশুর খেলার সঙ্গী হতে পারে। এতে শিশু এবং পরিবারের একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ অধিকতর দৃঢ় হবে।
প্রযুক্তিগত দিকে তদারকি
আধুনিক সময়ে সন্তান লালন-পালন এত সহজ নয়। শিশুরা ঠিক মত শাকসবজি খেল কিনা, সময়মতো ঘুমতে গেল কিনা কিংবা ঠিকঠাক স্কুলের পড়া করলো কিনা এসব দেখাই ছিল এক সময়ে বাবা-মায়েদের কাজ। আর এখন প্রযুক্তিগত দিকে তদারকিটা হয়েছে এ সময়ের পিতামাতাদের কাজের অতিরিক্ত একটি বিষয়। আমরা নিজেরা কতটা সময় অনলাইনে কাটাই এবং কতটা সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি, এটা বিবেচনা করেই সন্তানদের জন্যে উদাহরণ নিজেদেরই সৃষ্টি করতে হবে।
আসক্তি কাটিয়ে ওঠা কিভাবে সম্ভব?
স্ক্রিন আসক্তির ভয়াল আসক্তি মুক্তির উপায় কী? স্মার্টফোনের এরূপ আসক্তিকে বিজ্ঞানীরা ‘নোমোফোবিয়া’ বলছেন। এ নোমোফোবিয়া থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞরা কিছু উপায় জানিয়েছেন।
ফোন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ
স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করুন। দিনে কতবার স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন তা ঠিক করে নিন। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন দিনে ২০ বারের বেশি স্মার্টফোন দেখবেন না। এ ছাড়া খাওয়া ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না।
স্মার্টফোন নিয়ে বিছানায় নয়
ঘুমানোর আগে ফোন বন্ধ করে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। ঘুমানোর সময় ফোন বন্ধ করলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই ভেবে ফোন বন্ধ করে দিন। ঘুম কম হওয়া বা অনিদ্রার অন্যতম একটি কারণ স্মার্টফোন আসক্তি। অনেকে সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য স্মার্টফোনে অ্যালার্ম সেট করেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ব্যবহারকারীরা ঘুম থেকে উঠে অ্যালার্ম বন্ধ করে ফোনের নোটিফিকেশন চেক করা শুরু করে দেন। এতে অনেক সময় কেটে যায়। এমন সমস্যা এড়াতে স্মার্টফোনে অ্যালার্মের বদলে অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ
আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোন থেকে অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ সরিয়ে ফেলুন। স্মার্টফোনে ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপগুলো দরকারি হলেও আসক্তি কমাতে চাইলে এসব অ্যাপ সরিয়ে ফেলতে হবে। স্মার্টফোনে আরও অনেক অ্যাপ আছে, যেগুলো সময় নষ্ট করে। এ ধরনের অ্যাপ সরালে আপনার মূল্যবান সময় বাঁচবে এবং ফোনের স্টোরেজ ও চার্জ কম ফুরাবে।
আড্ডায় স্মার্টফোন পরিহার
অনেকেই পারিবারিক কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার মাঝেও স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন হালকা হয়ে যায়। তাই এসব পরিস্থিতিতে স্মার্টফোন এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
মেডিটেশন
দিনে অন্তত ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন বা অন্য কোনো মেন্টাল রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজের জন্য নির্ধারিত রাখুন। শুধু মোবাইল নেশা নয়, যে কোনো ক্ষেত্রেই নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার এটি একটি কার্যকর উপায়।