আনিসুর রহমান এরশাদ
পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ দেশ মোনাকো। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ। অনেক দেশের ধনীরা এখানে সম্পদ লুকিয়ে রাখে। দেশটিতে রয়েছে অনেক বিত্তশালী লোকের বাস। মোনাকোর বর্তমান মাথাপিছু আয় হলো পৃথীবির সর্বোচ্চগুলোর একটি। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। মোনাকো একটি দেশ যেখানে কোনো কৃষি বা গ্রাম নেই। দেশটির পুরো অংশই শহর। আজ জানাব আয়তনে পৃথিবীর ২য় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র মোনাকো সম্পর্কে।
একনজরে মোনাকো
সাংবিধানিক নাম: প্রিন্সিপালিটি অব মোনাকো
রাজধানী: মোনাকো সিটি
বৃহত্তম শহর: মন্টি কার্লো
দাফতরিক ভাষা: ফ্রেঞ্চ
বর্তমান শাসক: প্রিন্স আলবার্ট দ্বিতীয়
মিনিস্টার অফ দ্যা স্টেট: পিয়েরে ডার্টআউট
প্রেসিডেন্ট অফ দ্যা ন্যাশনাল কাউন্সিল: স্টিফেন ভ্যালেরাই
মুদ্রা: ইউরো
আয়তন: ২.০২ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যা: ৩৯ হাজার ৪৬৮ জন
জনসংখ্যার ঘনত্ব: প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৮৬৬১ জন
মাথাপিছু আয়: ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬১ মার্কিন ডলার
বাৎসরিক জিডিপি: ৫.৭৪৮ বিলিয়ন ডলার
গড় আয়ু : ৮৯ বছর
মোনাকোর অবস্থান
পশ্চিম ইউরোপের ফ্রেঞ্চ রিভিএরায় অবস্থিত মোনাকো। ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের দেশটির তিন পাশেই রয়েছে ফ্রান্স এবং এক পাশে রয়েছে ভূমধ্যসাগর। ইতালির খুব কাছাকাছি। সবচেয়ে সমৃদ্ধ মন্টে-কারলোকেই দেশটির প্রধান শহর বা কেন্দ্র মনে করা হয়ে থাকে। ফরাসি ভাষা বহুল ব্যবহৃত। মনোকার ম্যাপ দেখলে মনে হয় একটি হাতির মাথা। যে মাথাটা অদ্ভূত ভঙ্গিতে তার শুঁড় পরাবাস্তবতার মতো উঁচিয়ে ধরেছে।
মোনাকোর ইতিহাস
ল্যাটিন মোনিকাস শব্দ হতে প্রাচীন গ্রিক শব্দ মোনোইকোস শব্দের উদ্ভব। এর অর্থ একাকি বসবাস। এ একাকি বসবাস থেকে মোনাকি শব্দের উদ্ভব। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ফোসিয়ান গ্রিকদেও একটি কোলোনির সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে উপদেবতা হারকিউলিস এর পূজা হতো। একজন প্রধান সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে একদল সন্ন্যাসী পূজা-কার্য সম্পন্ন করতেন। প্রধান সন্ন্যাসী একাকি বসবাস করতেন। ইতালিয়ান ভাষায় সন্ন্যাসীদের বলা হতো মোনাকি। মোনাকি হতে মোনাকো নামের উদ্ভব। একাকি বসবাসরত এ সন্ন্যাসীকে ঘিরে জনপদটি গড়ে উঠেছিলো।
মোনাকোর রাজনীতি
মোনাকোর রাজনীতি মূলত রাজতন্ত্র নির্ভর। সেখানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও শাসনতন্ত্র প্রচলিত। বর্তমান শাসক প্রিন্স আলবার্ট দ্বিতীয়। ২০১১ সালে জুলাই মাসে প্রিন্স আলবার্ট-২ বিয়ে করে শার্লিন উইটস্টোককে। এই প্রিন্স দম্পতি জমজ বাচ্চার অধিকারী হন। তাদের নাম জ্যাক ও গাব্রিলা। মেয়ে গাব্রিলা বড় হলেও পুরুষ উত্তরাধিকার সূত্রে জ্যাক শহরটির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবেন।
মোনাকোর স্বাধীনতা
মোনাকো রিপাবলিক অব জেনোয়া থেকে ১২৯৭ সালে ৮ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে। ১৮৬১ সালে ফ্রান্স ও মোনগাস্ক চুক্তির মাধ্যমে মোনাকো ফ্রান্সকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে কিন্তু শহরটির একক স্বায়ত্বশাসন তাদের হাতেই রয়ে যায়। গ্রিমাল্ডি ফ্যামিলি ১২৯৭ সাল থেকে ১৭৯৩ (৪৯৬) বছর এককভাবে রাজত্ব করেছিল। মোনাকো স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৯৯৩ সালের ২৮ মে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯১১ সালে সর্ব প্রথম তারা সংবিধান তৈরি করে, যা ২০০২ সালে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। ২০০২ সালে আবার ফ্রান্সের সাথে মোনগাস্কের আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় গ্রিমাল্ডি রাজতন্ত্র বিলুপ্তির ব্যাপারে। দেশটির রাজধানী মন্টি কার্লো ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মোনাকোর চালিকা শক্তি
পর্যটনশিল্পই মোনাকোর প্রধান চালিকা শক্তি। জনগণের জীবনযাত্রার মানও খুব উন্নত। দেশটির মোট বার্ষিক রাজস্বের প্রায় ১৫ শতাংশ আসে পর্যটনশিল্প থেকে। এখানে প্রতি বছর প্রায় ১.৫ মিলিয়ন পর্যটক আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন, প্রাইভেট ও সরকারি ব্যাংকিং খাত (ফরেন কোম্পানি রিজার্ভ)। মোনাকোতে বিশ্বের অনেক নামিদামি আন্তর্জাতিক ব্যাংক রয়েছে, যারা তাদের গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষা করে। এ ছাড়া বিখ্যাত ফর্মুলা-ওয়ান রেশের জন্য ট্রাক চলে গেছে এই দেশের ওপর দিয়ে।
ধনীদের দেশ
মোনাকোতে ১২৫ দেশের মানুষ বসবাস করে। মোনাকোতে দেশের জনগণকে কোন আয়কর দিতে হয় না। স্থানীয়দের মোনগাস্ক ও মোনাকান নামে ডাকা হয়। পতাকা দেখতে হুবহু ইন্দোনেশিয়ার মতো। মোনোকোর পতাকা ১৮৮১ সালের ৪ এপ্রিল গৃহীত হয়। মোনাকোর জিডিপির সবচেয়ে বড় খাত হলো ক্যাসিনো। তবে মোনাকোর নাগরিকরা ক্যাসিনোতে প্রবেশ করতে পারে না। একটি রাজ পরিবার মোনাকোর সম্পূর্ণ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক দেখাশোনা করে। মোনাকোতে পৃথিবীর সবচেয়ে কম দরিদ্র লোক বসবাস করে।
সামরিক ক্ষমতা
মোনাকোর সামরিক ক্ষমতা খুবই সীমিত। বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য দেশটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রতিবেশী ফ্রান্সের উপর নির্ভরশীল। তবে দেশটিতে ২৫৫ সৈন্য আছে। ৫১৫ জন পুলিশ আছে।
স্বপ্নের রাজ্যে ভ্রমণ
মোনাকোর নিজস্ব কোনো ভিসা পদ্ধতি নেই কিন্তু ফ্রান্সের সাথে প্রতিবেশী চুক্তির কারণেই ভিসার ক্ষেত্রে সেনজেন নীতি পালন করে থাকে। সেনজেন ভিসা থাকলে মোনাকো ভ্রমণ করা যায়। লেটার অব ইন্টারেস্ট দিতে হয় অর্থাৎ কেন মোনাকো যেতে চান তা লিখিতভাবে জানাতে হয়। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লেটার থাকতে হয়।
ভিসা পাওয়ার পরে প্রথমে ফ্রান্সের নিশ শহরে ‘কটি ডি আজুর এয়ারপোর্টে’ যেতে হয়। আর সেখান থেকেই এয়ারবাসে চলে যাওয়া যায় স্বপ্নের রাজ্য মোনাকোতে। ভিআইপিদের জন্য রয়েছে হেলিপোর্ট সার্ভিস। ফ্রান্সের নিশ এয়ারপোর্ট আর মোনাকোর হেলপোর্ট হচ্ছে একমাত্র উড়ন্ত যাতায়াত ব্যবস্থা।
সুরক্ষিত দেশ
সকালের খবরের কাগজে মোনাকোর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা অপরাধের খবর থাকে না। ধনীদের এ দেশটি সুরক্ষিত, অপরাধ মুক্ত। হাজার হাজার ক্যামেরার চোখ নজর রাখছে দেশের আনাচে কানাচে। পাহারাদার সদা সতর্ক। দেশের সব গাড়ি, এমনকি নতুন আসা গাড়িরও ছবি ও নম্বর প্লেটের ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যান করে দেশের সুরক্ষা ডাটাবেসের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়।
আকর্ষণ ক্যাসিনো
দেশটির প্রধান আকর্ষণ ক্যাসিনো বা জুয়াখেলার আখড়াগুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত জুয়াড়িরা এখানে আসে জুয়া খেলতে। জুয়াড়িদের ভোগবিলাসের জন্য খুবই বিখ্যাত এই দেশ। সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যাসিনো মোন্টে-কারলো ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ সালে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর বসে মন্টে কার্লোতে। এটিই জুয়াড়িদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মোনাকো সরকার ১৯২৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে মোনাকো গ্রান্ড প্রিক্স (কার রেইস প্রতিযোগিতা) আয়োজন করে থাকে। এটি প্রতি বছরই মে মাসে আয়োজন করা হয়। তবে ক্যাসিনোগুলোতে মোনাকোবাসীর প্রবেশ নিষিদ্ধ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের পর্যটককে আকর্ষণ করবেই এই দেশটি। সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত মোনাকো। সারা বিশ্বের ধনীদের কাছে এটি আকর্ষণীয় একটি জায়গা। পৃথিবীর সব মিলিয়নিয়ার, বিলিয়নিয়ার, হলিউডের সুপার স্টাররা এখানে ছুটি কাটাতে আসে।
মোনাকোর সমুদ্র বন্দরে গেলে দেখা যায় শতশত ছোট বড় অত্যাধুনিক প্রমোদতরী। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ও বড় ইয়ট মোনাকোর সমুদ্রে ভাসে। মোনাকোর সংস্কৃতি মূলত ফ্রান্সের সাথে সম্পর্কিত।
বিলাসিতা ও আভিজাত্য
পায়ে হেঁটে পুরো দেশ ঘুরতে লাগে মাত্র ৫৬ মিনিট। যে কারণে এ দেশের বাসিন্দারা সারাদিন নিজেদের দেশকে একবার নয়, অনেকবারই চক্কর দেন! যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক থেকেও ছোট। জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কোটিপতি। অনেক বিলাসবহুল দালান।
স্থানীয় জনসংখ্যার পাশাপাশি প্রতিদিন প্রতিবেশী ফ্রান্স ও ইতালি থেকে ৪০ হাজার লোক যায় কাজের জন্য। ফলে স্থানস্বল্পতায় প্রতিদিন পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। বর্তমানে দেশটির ৭০ ভাগ নাগরিকেরই বিদেশে জন্ম। বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ যাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে দেশটির আয়তনও বাড়ছে।
আয়তন বাড়ানোর প্রকল্প
নতুন করে ভূমধ্যসাগরের দিকে দেশটির আয়তন আরও ১৫ একর বাড়ানোর জন্য ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হলে সেখানে নতুন জেলা সৃষ্টি করা হবে।
এতে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ও ভিলা তৈরি করা হবে, যাতে এক হাজারের বেশি মানুষের আবাসন হবে। এর বাইরে থাকবে পাহাড়, উদ্যান, উপকূলীয় ভ্রমণ এলাকা। মোনাকো বসবাসের জন্য বিশ্বের অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন এলাকা। ফলে দেশের আয়তন বাড়ানোর এই প্রকল্প হচ্ছে।
খেলাধূলা
মোনাকোতে আছে নিজস্ব ফুটবল দল ও একটি ফুটবল মাঠ। এ মাঠে মোনাকোর অর্ধেক লোক একসঙ্গে খেলা দেখতে পারে।