আনিসুর রহমান এরশাদ
বর্তমান বিশ্বে পর্যটন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের শিল্প মাধ্যম, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আঁধার। আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়, দ্রুত উন্নয়নশীল, অর্থকারী, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সংবেদনশীল শিল্প। শতাব্দীর সেরা, দ্রুত বিকাশমান ও বিশ্বব্যাপী সর্ববৃহৎ শিল্প হিসেবে স্বীকৃত একক বৃহত্তম শিল্প পর্যটন। বিগত বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পর্যটন শিল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে পর্যটন শিল্প। পর্যটন শিল্প পৃথিবীব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, পর্যটকের ভ্রমণের বিষয়টি নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরো মজবুত করেছে এবং পর্যটন শিল্প জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো জোরালো করে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে; যা পৃথিবীব্যাপী ভোরের ফুটন্ত আলোর মতো উজ্জ্বলভাবে বিকশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বর্ধনশীল বহুমাত্রিক শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী পর্যটন শিল্প বিশ্বজুড়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল বাণিজ্যিক কর্মকান্ড হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
যেভাবে বদলে দিবে অর্থনীতি
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম পর্যটন। পর্যটনকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করে টেকসই উন্নয়নের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার লক্ষ্যে সচেতনতা সৃষ্টির নিমিত্তে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী পর্যটন দিবস পালিত হয়। সকলের জন্য পর্যটন; সার্বজনীন পর্যটনের অভিগম্যতা। শতকোটি পর্যটক, শতকোটি সম্ভাবনা।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প একটি সম্ভাবনাময় খাত। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার কোনোটারই অভাব নেই এই দেশে। কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটারের সুদীর্ঘ অথচ অবিভক্ত প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত; কুয়াকাটায় দাঁড়িয়ে সাগর থেকে সূর্য উদয় হয়ে সাগরেই অস্ত যাওয়ার বিরল দৃশ্য; বিশ্বের সবচাইতে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বিশিষ্ট সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান আচ্ছাদিত সবুজ পাহাড়ের সমারোহ, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ির সুউচ্চ পাহাড়ে শ্বেত-শুভ্র মেঘের মোলায়েম পরশ গ্রহণের সুযোগ; জাফলং এর অবিরাম ঝরণা ধারা আর সেন্ট মার্টিনের অপরূপ দৃশ্য। সেইসঙ্গে সহস্রাব্দ প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য, কৃষ্টি সভ্যতার নিদর্শন উপভোগ করার সুযোগ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্যামল বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিরাট সম্ভাবনার দাবি রাখে।
দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধির সহায়ক
আগামী এক দশকে পর্যটন খাতে যে ১২টি দেশ দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি করবে, সেখানেও আছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের প্রতিবেদনে এই আশাবাদের কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান লোনলি প্ল্যানেট বলেছিল, বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য পৃথিবীর সেরা দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক। কেননা আজকের মানুষ চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাক্সক্ষা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দিক দিয়ে অধিকতর ভ্রমণশীল ও গতিশীল। বর্তমানে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে নান্দনিক চাহিদার মাধ্যমে পর্যটন তথা ভ্রমণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার অফুরন্ত প্রাকৃতিক শোভার কোনো তুলনা নেই। এমতাবস্থায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে আমরা ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারি।
নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনা দেখছে বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি)। তারা বাংলাদেশে ভ্রমণ এবং পর্যটন ও অর্থনৈতিক প্রভাব শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে , বাংলাদেশে পর্যটন খাতের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হলে এই খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ রফতানি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এক চমৎকার নজির স্থাপন হতে পারে। কেননা উন্নত পর্যটন শিল্প বিকাশের সকল উপাদানই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সহজলভ্যতায় বিরাজমান। যারা শুধু অবসর সময়টুকুতে দেশ দেখতে আসেন- তাদেরই বলা হয় হলিডে মেকার্স। যারা সরকারি এসাইনমেন্ট বা ব্যবসায়িক কাজে এসে অতিরিক্ত সময়ে বিভিন্ন স্থান দর্শন ও ভ্রমণ করেন তাদের বলা হয় ডুয়েল ট্যুরিস্ট। এ দু’ক্যাটাগরির ট্যুরিস্টের সংখ্যাই বাড়ছে। নাসরিন (১৯৯৮৪) রব (১৯৮৪) এর ধারণা হলো, বাংলাদেশের ভূমিরূপের দর্শনীয় বস্তুসমূহ চিত্তবিনোদনের আকর্ষণ ঘটতে সক্ষম। দেশের আনাচে-কানাচে অরক্ষিত ঐতিহ্যমন্ডিত দর্শনীয় স্থানগুলোকে সুরক্ষিত করার উদ্যোগ নিলে স্থানীয়ভাবে বহু লোকের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সামাজিক উন্নয়ন
বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক দৃঢ়তার পেছনে পর্যটন খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ২০১৫ সালে জিডিপিতে এই খাতের প্রত্যক্ষ অবদান ২ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪০৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন টাকা এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মোট অবদান ৮০৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন টাকা বা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যা ২০১৪ সালে ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল জিডিপিতে এই খাতের অবদান বেড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বা স্বদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৫৯৬ বিলিয়নে দাঁড়াবে আর মোট জিডিপিতে অবদান রাখবে ৫শতাংশ। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ সবুজ প্রকৃতি, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিদেশিদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। ইতিহাস-ঐতিহ্যে বাজার সত্যিকারভাবেই সমৃদ্ধ। মানুষের ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বৈচিত্র্যশীল প্রকৃতির মতই বৈচিত্র্যশীল চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাক্সক্ষা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের আলোকে ভিন্ন হয়। পর্যটকদের বিভিন্ন ধরণের উদ্দেশ্যই যাতে পূরণ হয় সেভাবে এসব স্পটকে প্রস্তুত করতে হবে।
বিশাল সম্ভাবনার দ্বার
পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যথেষ্ট থাকায় বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং শিল্প হিসেবে এর উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে উন্নত করতে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন বৌধ বিহারগুলোকে ওয়াল্ড হেরিটেজে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা করছে। কক্সবাজার, বান্দরবন, কুয়াকাটা, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের নানা এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব এলাকা ঘিরে পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়েছে। এসব এলাকায় পুরাকীর্তিতে সংরক্ষিত আছে অনেক প্রত্নতাত্মিক নির্দশন। এই পুরাকীর্তিগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। এগুলো সংরক্ষণ ও বিহারগুলোর উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। সরকার বাংলাদেশের পর্যটন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এই খাতে যারাই বিনিয়োগ করবে তাদের সকল ধরণের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। তবে এটা সত্য, বেসরকারি উদ্যোক্তারাও পর্যটনের ভিত্তি মজবুত করেছেন। পর্যটনখাত ধীরে ধীরে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
পর্যটন শিল্প তার বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসেব মতে, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ে ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনে ৫০ শতাংশ ও থাইল্যান্ডে ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোও মূলত পর্যটননির্ভর। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এছাড়াও বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
এক স্বপ্নের দেশ
যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছে চির সবুজ ঘেরা বাংলাদেশ এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে বিবেচিত। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো এদেশে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার নির্দশন এবং নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন, বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ, বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, বিশ্বের দীর্ঘতম ১১১ কি.মি দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবনসহ অনেক স্থ্ান। আমাদের বান্দরবনের স্বর্ণ মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দির, ময়নামতি, মহাস্থানগড় কিংবা বিরিশিরির মতো নয়নাভিরাম হাওড়গুলো, সোনারগাঁও পানাম নগর অথবা এর জামদানী শাড়ি, নকশি কাঁথা থেকে শুরু করে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের সংস্কৃতি রয়েছে।
সব সম্পদে সমৃদ্ধ
প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময়ী দেশ বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে অপরিমেয় সৌন্দর্য। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক সব সম্পদেই সমৃদ্ধ। এই দেশে রয়েছে নাফাখুমের মত জলপ্রপাত তেমনি রয়েছে মাধবকুন্ড, হিমছড়ি, কিংবা লাউয়াছড়া, লালাখাল, বিছানাকান্দির মত দর্শনীয় স্থান। রয়েছে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, মহেশখালী আর সেন্টমার্টিনের মতো দ্বীপ। কক্সবাজার ছাড়াও আরও সমুদ্র সৈকত আছে পতেঙ্গা ও কুয়াকাটায়। রয়েছে কেওকারাডং এর মতো সুউচ্চ পাহাড়, রয়েছে রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রীজ। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে সবুজ চা-বাগান, রয়েছে মনিপুরী কিংবা চাকমাদের রাস নৃত্য। একদিকে যেমন রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে লাল বাগের কেল্লা তেমনি অন্যদিকে রয়েছে সুন্দরবনের মত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যার রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। আম, কাঁঠাল, মোঘল খাবার থেকে শুরু করে দোয়েল, কোকিল কিংবা কৃষ্ণচূড়ার এই দেশে কি নেই!
সুখী ও হাস্যোজ্জ্বল মানুষ
প্র্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশের জ্ঞানী-গুণী পর্যটক এদেশে এসেছেন এবং এদেশের রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। প্রতিবছর সৌন্দর্য পীপাসু পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে যুগে যুগে অনেক পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী এসেছেন। বিস্তীর্ণ পাহাড়-পর্বত, ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বিশ্বেরও দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, প্রাচীন, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন এদেশের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। তাই এদেশে পর্যটন শিল্পের রয়েছে অপরিসীম সম্ভাবনা। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) মহাসচিব তালেব রিফাই বলেছেন,‘আমি এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখেছি। আমি সেই যানজট দেখিনি, যা নিয়ে মানুষ কথা বলে। আমি স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি। আমি দেখেছি এখানকার মানুষ সুখী এবং হাস্যোজ্জ্বল। দিন শেষে আমার কাছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানকার ছয়টি ঋতু সম্পর্কে ধারণা আমার আছে। আমি অবশ্যই এখানে ফিরে আসব। আমার পরিবারকেও সঙ্গে নিয়ে আসব। এটি বসবাসযোগ্য অসাধারণ একটি দেশ। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে আরও শান্তি, সৌহার্দ্য, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে ভরপুর।’
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের সমস্যা
সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব
সম্ভাবনার আধার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বহুমুখী সমস্যার আবর্তে আজ সঙ্কটাপন্ন। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সমস্যা, বেসরকারি উদ্যোগের অপর্যাপ্ততা, সরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়ন সমস্যা, নিরাপত্তার অভাব, প্রচারের অভাব, সাবলীল উপস্থাপনার অভাব এবং দেশের অস্থিতিশীলতা। পর্যটন শিল্পের প্রচার এবং প্রসারের জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয়ের উদ্যোগের অভাব রয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের এ শিল্প অনেকটা আড়ালে পড়ে রয়েছে।
নিরাপত্তা জনিত সমস্যা
প্রধান প্রতিবন্ধকতা সমূহ হচ্ছে- আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অরক্ষিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও সড়ক দুর্ঘটনা, বিদেশি হত্যাকান্ড ও জঙ্গি তৎপরতা বিষয়ক প্রোপাগান্ডা, অনুন্নত হোটেল ও মোটেল ব্যবস্থাপনা এবং অপর্যাপ্ত বিনোদন ব্যবস্থা, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা, নানাবিধ সামাজিক অপরাধের কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া, বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা জনিত সমস্যা।
সর্বত্র পরিবেশ দূষণ
এছাড়া রয়েছে- কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের সমুদ্রসৈকত, রাঙ্গামাটির সুভলং ঝর্ণা এবং বান্দরবানের শৈলপ্রপাত ও বগা লেক তথা সর্বত্র পরিবেশ দূষণ। কক্সবাজার ও কুয়াকাটার মতো স্থানে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোকে এপার্টমেন্ট ব্যবসার অনুমোদন দেয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এই শিল্পে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত। ট্যুর অপারেটর্স এ্যাসোসিয়েশন্স অব বাংলাদেশ (টোয়াব) জানায়, পর্যটন খাত বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে আছে পর্যাপ্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তার অভাব, যানবাহন ও যোগাযোগের দুর্বলতা, হোটেল মোটেল ও রিসোার্টের অপ্রতুলতা।
যেভাবে বদলে যাবে ভবিষ্যত
পৃথিবীর বৈচিত্র্যশীল প্রকৃতির মতই আজকের মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে অধিকতর ভ্রমণশীল ও গতিশীল। পর্যটন শিল্প তাই বর্তমান বিশ্বে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার অবকাশ রাখে। এছাড়া পর্যটনের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি বর্হিবিশ্বে প্রচার এবং আন্তর্জাতিক সুনাম ও সুসম্পর্ক তৈরি করা যায়। পর্যটন একটি সংগঠিত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ‘ট্যুরিজম সুনারিও ‘দৃষ্টিভঙ্গিতে ভ্রমণ আধুনিক অর্থনীতির চতুর্থ ধারা, পর্যটনের গুরুত্ব শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রপঞ্চতে প্রভাব বিস্তার করে না। ইহা সামাজিক ও সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।
বালি বা থাইল্যান্ডের বিকল্প
George (১৯৮০) উল্লেখ করেন, কোন একটি দেশের পর্যটনের উন্নয়নের সাথে সে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা জড়িত। ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রচুর। নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল হওয়ায় পশ্চিমা ভ্রমণবিলাসীদের কাছে ইন্দোনেশিয়ার অবকাশ কেন্দ্র বালি অথবা থাইল্যান্ডের চমৎকার বিকল্প হতে পারে বাংলাদেশ। পর্যটন শিল্প সম্পর্কে অভিজ্ঞদের মতে, আধুনিক ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তোলা হলে পর্যটকের সংখ্যা বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা অন্তত দশগুন বাড়বে। ফলে রাজস্ব আয় দাঁড়াবে ন্যূনতম ২০ হাজার কোটি টাকা।
প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
George (১৯৮০) পর্যটনকে একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করেন। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পর্যটনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো সম্ভব। পর্যটকদের জন্য কেনাকাটার সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।
দারিদ্রতা দূরীকরণ
দেশের দারিদ্রতা দূরীকরণের উপায় হিসেবে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। জনসাধারণের মধ্যে পর্যটনের প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধিকরণ ও তাদের জন্য অল্পখরচে পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টি এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখা যেতে পারে। এতে বেশি সংখ্যক নাগরিকের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। এতে বেসরকারি পুঁজির জন্য একটি স্বীকৃত বিনিয়োগের ক্ষেত্র উন্মোচিত হতে পারে। যা বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতি।
বেকার সমস্যার সমাধান
পর্যটন শিল্প সম্পর্কিত এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বিশ্বের সব জনগোষ্ঠীর প্রতি ১১ জনের মধ্যে গড়ে একজন বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটন পেশার সঙ্গে জড়িত। সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় আমাদের দেশের বেকার সমস্যার সমাধানে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বাড়াতে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব কত বেশি।
আশানুরুপ রাজস্ব আয়
শুধুমাত্র সমুদ্র সৈকতকে কেন্দ্র করে প্রচুর মুনাফা অর্জন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব এবং পাশাপাশি বিরাট আকারের বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব। পর্যটন বাংলাদেশের অন্যতম বিনিয়োগ ও আয়ের মাধ্যম হতে পারে । এটি জাতীয় রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূূর্ণ অংশ পূরণ করে জিডিপিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারে। তৌফিক রহমানের ‘আলো আঁধারে বাংলাদেশের পর্যটন’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্প এককভাবে প্রায় ১১ শতাংশ অবদান রাখছে, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার।
সীমান্তে দাঁড়িয়ে
পর্যটনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনাময়। এ বিপুল সম্ভাবনার বিকাশের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় করার অন্যতম উপায় পর্যটন শিল্প। দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পর্যটন অপরিহার্য নিয়ামক। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটন শিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে। এজন্য যথাযথ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃৃতিক বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে লাখো দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব। আমরা চাই পর্যটন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।